স্বরূপ গোস্বামী
বিজেপির একদফা প্রার্থীঘোষণা হয়ে গেছে ভোটঘোষণার অনেক আগে। সেইসব প্রার্থীরা অনেক আগে থেকেই নেমে পড়েছেন প্রচারে। অনেকের নাম হয়তো সরকারিভাবে ঘোষণা হয়নি, কিন্তু তাঁরাও জেনে গেছেন, প্রার্থী হচ্ছেন। ফলে মাঠে নেমে পড়েছেন। ব্রিগেড সমাবেশ থেকে তৃণমূলও একসঙ্গে ৪২ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে দিয়েছে। সেইদিন থেকেই সবাই নেমেও পড়েছেন। স্থানীয় জট, মান অভিমান, ক্ষোভ–বিক্ষোভ দু তিনদিন কাগজে শিরোনাম হয়েছে। কিন্তু দু’তিন দিনে ড্যামেজ কন্ট্রোলও হয়ে গেছে। বেসুরো লোকেরা দিব্যি ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’ গাইতে শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু এখনও বিস্তর জট থেকে গেছে তৃতীয় শক্তির জোটকে ঘিরে। তৃতীয় শক্তি বলতে বাম, কংগ্রেস, আইএসএফ।
তৃণমূলের সঙ্গে যে বামেদের জোট হচ্ছে না, তা অনেক আগে থেকেই পরিষ্কার। কংগ্রেসের সঙ্গেও যে তৃণমূলের জোট হবে না, এই চিত্রটা মাস দেড়েক আগে ঠিক হয়ে গেছে। বাম, কং, আইএসএফ–কে মিলিতভাবে লড়তে হবে, এটাই চরম বাস্তবতা। তারপরেও মাসের পর মাস এত গড়িমসি কেন?
তিন শিবিরকে দেখলে মনে হবে, এঁরা বোধ হয় কেউ কাউকে চেনেন না। কেউ কোনওদিন কাউকে চোখেও দেখেননি। কারও সঙ্গে কারও কোনওদিন কথাই হয়নি। এমন ছত্রভঙ্গ অবস্থা নিয়ে আপনারা জোটে যাবেন? সেই জোটকে মানুষ কেন বিশ্বাস করবে?
কংগ্রেসের দিল্লি নেতৃত্বের কারও কারও তৃণমূল সম্পর্কে দুর্বল মনোভাব ছিল। তাঁরা নানা কারণে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চেয়েছেন। সেটা তাঁদের বাধ্যবাধকতা। অন্তত অধীর চৌধুরি যে তৃণমূলের সঙ্গে জোট চাননি, এটা তো পরিষ্কার। এখনও তিনিই দলের রাজ্য সভাপতি, এটাও পরিষ্কার। তাহলে, তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা অনেক আগে থেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া গেল না কেন? বাম নেতৃত্ব বলতেই পারেন, কথা হয়নি, কে বলেছে? হয়তো খাপছাড়াভাবে হয়েছে। কিন্তু এত দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরেও সমন্বয়ের এত অভাব কেন?
বড় শরিক হিসেবে বড় দায় অবশ্যই সিপিএমের। প্রথমে শরিকদের সঙ্গে বসা, তাঁদের বোঝানো। পরে কংগ্রেসের সঙ্গে বসা। তারপর আইএসএফের সঙ্গে বসা। সবথেকে বেশি আত্মত্যাগ অবশ্যই সিপিএমকেই করতে হয়েছে। করতে হবেও। সংসারে বড় দাদার ভূমিকা যে অনেক বেশি। ধরা যাক, আইএসএফের কথা। তারা নতুন দল। তেমন সাংগঠনিক কাঠামো হয়তো তৈরি হয়নি। তারা বামফ্রন্টের অংশও নয়। ফলে, ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি বা সিপিআইয়ের সঙ্গে যেভাবে কথা হয়, নিয়মিত বৈঠক হয়, আইএসএফের সঙ্গে সেই সিস্টেমে কথা হওয়া সম্ভবও নয়।
প্রায় মাস ছয়েক আগে থেকেই নৌশাদ সিদ্দিকি ঘোষণা করেছেন, তিনি ডায়মন্ড হারবার থেকে লড়াই করবেন। এভাবে একতরফা ঘোষণা করা যায় কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। কিন্তু তিনি যে মোটামুটি একটা লড়াই দিতে পারবেন, এটা ঘটনা। তিনি যে এত প্রলোভন, এত হুমকির মুখেও বিকিয়ে যাননি, গুটিয়ে যাননি, এটাও ঘটনা। তিনি যে জোটের একমাত্র বিধায়ক, এটাও ঘটনা। গত তিন বছরে তিনি যে একটা বিশ্বাসযোগ্য মুখ হয়ে উঠেছেন, এটাকে অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই। এইদিক গুলো মাথায় রেখে তাঁর আরও একটু সম্মান কি প্রাপ্য ছিল না? তাঁর সঙ্গে বা তাঁর দলের সঙ্গে কি আরও একটু ধৈর্য নিয়ে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া যেত না? অনেক দেরিতে বিকাশ ভট্টাচার্যের মতো মানুষকে কাজে লাগানো হল। এটা কি তিন–চার মাস আগে থেকে করা যেত না? তাহলে, এতখানি জট তৈরি হত না।
কংগ্রেস যত আসন চাইবে, হয়তো সংগঠনের নিরিখে এত আসন তাদের প্রাপ্য নয়। কং নেতৃত্বও সেটা জানেন না, এমন নয়। কিন্তু তাঁদেরও নানা বাধ্যবাধকতা থাকে। কর্মীদের, জেলার নেতাদের বোঝাতে হয় যে, আমরা অনেক বেশি আসন দাবি করেছি। দক্ষিণপন্থী দলে এটুকু গ্যালারি শো থাকাটাই স্বাভাবিক। আলাপ–আলোচনায় জট অনেকটাই কাটতে পারত। ভুল বোঝাবুঝি অনেকটাই দূর হতে পারত। কিন্তু তিন শিবিরের সাংবাদিক বৈঠক শুনুন। একে অন্যের ঘাড়ে দায় ঠেলতেই ব্যস্ত। শুনলেই মনে হবে, এদের জোট করার কোনও ইচ্ছেই নেই। নেহাত দায়ে পড়ে করতে হচ্ছে।
আচ্ছা, বাম, কংগ্রেস, আইএসএফ মিলিতভাবে কটা আসন পেতে পারে? এক বা দুই। যত বড়ই আশাবাদী হোন, চোখে দূরবিন লাগিয়েও এই মুহূর্তে সংখ্যাটা পাঁচের বেশি ধরা যাবে? হয়তো অনেকটা বেশিই দেওয়া হয়ে গেল। আপনি চান বা না চান, বাইনারি ঠিক হয়ে গেছে। মিডিয়াকে দোষারোপ করা ছাড়া এই বাইনারি ভাঙার জন্য তিন দল কী করেছে? প্রায় সব আসনেই লড়াই হবে তৃণমূল বনাম বিজেপি। চার–পাঁচটি আসন ছাড়া দ্বিতীয় হওয়ারও সুযোগ নেই। অর্থাৎ, যেখানে অন্তত নব্বই শতাংশ আসনে জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়াটাই অনিবার্য ভবিতব্য, সেখানেই এতখানি ঝগড়াঝাটি। তাহলে জেতার সম্ভাবনা থাকলে কী হত? মানুষের কাছে কোন ছবিটা তুলে ধরছেন? তৃণমূল বা বিজেপিকে অবিশ্বাস করার হাজারটা কারণ আছে। কিন্তু জোটের প্রতি বিশ্বাস থাকবে, তার কিছু ইতিবাচক কারণও থাকুক। যাঁরা নিজেরা নিজেদের বিশ্বাস করে না, যাঁরা একে অন্যের মুখ দেখে না, তাঁদের ওপর মানুষ আস্থা রাখবেন কী করে?
মাঝেমাঝেই শোনা যায়, তৃণমূল ও বিজেপি বিরোধী মানুষদের একজোট করতে হবে। আরে বাবা, সে তো অনেকদূরের ভাবনা। আগে তো নিজেদের একজোট হতে হবে। নিজেরা একজোট হতে পারছেন না। একসঙ্গে হাঁটতে পারছেন না। মানুষকে একজোট করবেন? ভাবলেন কী করে? যদি ভেবেও থাকেন, বললেন কোন সাহসে?