‌ঢের হয়েছে গঙ্গাযাত্রা, আবার ফিরলাম পৃথিবীতে

সরল বিশ্বাস

গঙ্গার তলা নিয়ে মেট্রো চলবে!‌ শুনে আসছি তো বহুদিন ধরে। কিন্তু সত্যিই সেই মেট্রোয় চড়তে পারব তো!‌ আমাদের সবকিছুতেই সেই আঠারো মাসে বছর। যেটা এক বছরে হতে পারত, তার কাজ শেষ হতে হতে বারো–‌তের বছর লেগে যায়। কী জানি, গঙ্গার তলা দিয়ে মেট্রো চলার আগেই হয়তো কোথাও একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। হয়তো আবার বিশ বাঁও জলে চলে যাবে। এমন আশঙ্কা যে তাড়া করত না, তা নয়।

অবশেষে ভোটের আগে চালু হয়েই গেল। ইচ্ছে ছিল, প্রথমদিনেই সেই মেট্রো যাত্রার শরিক হব। এমন অনেক সিনেমাভক্তকে জানি, যাঁরা এখনও সেই ‘‌ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো’‌ দেখার জন্যই মুখিয়ে থাকেন। তাঁদের কাছে একটা দিন পেরিয়ে যাওয়া মানেই মহাভারত অনেকটাই অশুদ্ধ হয়ে যাওয়া। আমার অবশ্য তেমন তাগিদ নেই। তবে ভাল সিনেমা দেখতে দেরি হলে মনটা কেমন খচখচ করে। তেমনই যখন শিয়ালদা–‌সেক্টর ফাইভ মেট্রো চালু হল, কবে চাপব, কবে চাপব — এমন একটা ছটফটানি তাড়া করেছে।

তাই এবারও ইচ্ছে ছিল, যত দ্রুত সম্ভব, সেই মেট্রোয় চাপব। অবশেষে সেই ইচ্ছেপূরণ হল। গিয়েছিলাম হাওড়ায়। কয়েকজন নিকট আত্মীয়কে ট্রেনে তুলতে। ফেরার সময় মনে হল, এবার মেট্রো সফর করাই যায়। এই ট্রেন যে জলের বুক চিরে যাবে না, দু পাশে মাছ কিলবিল করবে না, এটা আগেই জানতাম। তবু গঙ্গার তলা দিয়ে যাচ্ছি। ভাবতে গেলেই একটা রোমাঞ্চ কাজ করে।

শুরুতেই বিস্তর বোকা বনে গেলাম। স্টেশনের বাইরে গিয়ে একে–‌তাকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম, মেট্রো স্টেশনটা কোনদিকে। একেকজন একেক রকম উত্তর দিলেন। কেউ হাত দেখিয়ে দিলেন নতুন প্ল্যাটফর্মের দিকে। কেউ ফেরিঘাটের দিকে। পরে একজন বললেন, ওটা স্টেশনের ভেতরে। কাকে ছেড়ে কার কথা যে বিশ্বাস করি!‌ কয়েকজন আরপিএফ জওয়ানকে জিজ্ঞেস করা যাক। তাঁরা নিশ্চয় জানবেন। অবশেষে বুঝলাম, সত্যিই স্টেশনের ভেতর। চোদ্দ নম্বর প্ল্যাটফর্মের কাছে।

মনে পড়ে গেল ‘‌আশিতে আসিও না’‌য় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই সংলাপটা, ‘‌আমি এখন জল পুলিশের আন্ডারে।’‌ মানে মেট্রোয় উঠতে গেলে প্ল্যাটফর্ম টিকিট কাটতে হবে। নইলে, টিটিকে কী করে বোঝাব যে আমি মেট্রোয় চড়তে চাই। আমি অবশ্য সদ্য স্টেশন থেকে বেরিয়েছি। ফলে, পকেটে প্ল্যাটফর্ম টিকিট ছিল। আর তার মেয়াদও ফুরোয়নি। কিন্তু যাঁরা শুধু মেট্রোয় আসবেন!‌ বা যাঁরা মেট্রোয় এসে ট্রেন ধরবেন ভাবছেন, তাঁরা টিকিট কাটবেন কোথায়?‌ মেট্রো থেকে বেরোলেই তো টিটি খপাত করে ধরবে। বলবে, টিকিট কই?‌ এ তো মহাঝামেলা!‌

যাক, সেই ঝামেলা এড়িয়ে অবশেষে‌‌ চোদ্দ নম্বরের কাছে গিয়ে একে–‌তাকে জিজ্ঞেস করে পাতালপ্রবেশ হল। টিকিট কাউন্টার খুঁজে পেতেও তেমন বেগ পেতে হল না। টিকিট কেটে আরেকপ্রস্থ পাতাল প্রবেশ। কোনদিকে ট্রেন আসবে। হাওড়া ময়দানটাই বা কোনদিকে, আর এসপ্ল্যানেড কোনদিকে, গুলিয়ে যাওয়ারই কথা। একটা ট্রেন এসে থামল। হুড়মুড়িয়ে সবাই চেপে গেল। সেই তালিকায় এই অধমও ছিল।

ও হরি। এই ট্রেন তো ধর্মতলা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। সবাই নামার জন্য তোড়জোড় করছে। তার মানে এত লোক মহাকরণে নামবে!‌ তাও আবার এই যাই যাই বিকেলে!‌ গতিক ভাল মনে হল না। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, এটা নাকি হাওড়া ময়দান। তার মানে ভুল ট্রেনে উঠে পড়েছি!‌ তার মানে, আমার মতো বাকিরাও ভুল ট্রেনেই হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ল!‌ আমি না হয় ভুলটা বুঝতে পারলাম। বাকিরা তো না বুঝে এই হাওড়া ময়দানে এসে ধর্মতলা খুঁজবে।

একজন বলল, নেমে গিয়ে নতুন করে টিকিট কেটে আবার উঠুন। নামতে আপত্তি নেই। আবার টিকিট কাটতেও আপত্তি নেই। কিন্তু আবার টিকিট কেটে ফিরে আসার আগেই তো এই ট্রেন ছেড়ে দেবে। তার মানে আরও আধঘণ্টার অপেক্ষা। এ তো মহা ঝামেলার ব্যাপার। অমনি ট্রেন এসে থামল হাওড়া ময়দানে। ট্রেন থামতে না থামতেই হুড়মুড়িয়ে ফের লোক উঠতে লাগল। যারা নামছে, তাদের নামতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হল। সব দরজা থেকেই প্রায় এক কোরাস, ‘‌আরে আগে নামতে দিন। তারপর তো উঠবেন।’‌ কে শোনে কার কথা। এ বিপুল জলতরঙ্গ রুধিবে কে?‌

অতএব, আমারও আর নামা হল না। মনে হল, এরা তো ধর্মতলাই যাচ্ছে। এদের ভিড়ে আমিও তো দিব্যি মিশে গেছি। নিশ্চয় আর নামার দরকার পড়বে না। আমার টিকিট তো ধর্মতলা পর্যন্তই। যথারীতি ট্রেন আবার এল হাওড়ায়। সেখানে পিলপিল করে আরেক রাউন্ড লোক উঠল। এবার নাকি গঙ্গার তলায় ঢুকবে। সবাই জানালার দিকে তাকিয়ে। তখনও কেউ ভাবছে, মাছ দেখবে। কেউ ভাবছে, হয়ত ডলফিন দেখবে। নিদেনপক্ষে গঙ্গার জল ঠেলে হয়তো যাবে। কোথায় বা কী?‌ অন্ধকার টানেলে একটা নীল আলো। তাকেই কেউ কেউ গঙ্গার জল ভেবে নিল। কেউ কেউ পেন্নাম ঠুকে দিল। কেউ পেছনে কাঁচের দরজা রেখে সেলফি তুলতে শুরু করে দিল। কারও কারও আবার নেটওয়ার্ক নেই দেখে মুখ ব্যাজার। এরইমাঝে ধ্বনিত হল সেই কণ্ঠস্বর, ‘‌আপনি চলেছেন হুগলি নদীর তিরিশ ফুট নীচ দিয়ে। আপনার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে নদী। ভারতে আর কোথাও এভাবে নদীর তলা দিয়ে মেট্রো যায় না। এই ঐতিহাসিক যাত্রা উপভোগ করুন।’‌ ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনিতে গিরিশ পার্ক বা ভবানীপুরেরের তলা দিয়ে যাওয়ার যা অনুভূতি, এখানেও তাই। তবু মনে মনে গঙ্গার তলা দিয়ে যাচ্ছি ভেবে না হয় একটু রোমাঞ্চ আনা গেল।

প্রথমে মহাকরণ, তারপর এল এসপ্লানেড (‌ধর্মতলা)‌। নামতে যাব, অমনি আবার সেই রেকর্ডে বাজানো কণ্ঠস্বর। আপনি এখন হুগলি নদীর তলা দিয়ে। .‌.‌.‌ওরে নদী পেরিয়ে কোন কাল চলে এসেছি। উঠলেই ধর্মতলার জনসমুদ্র। সেখানে কিনা নদীর তলা দিয়ে যাচ্ছি, এমন অনুভূতি আনতে হবে!‌ বুঝলাম, রেকর্ড সেট করা আছে। কিন্তু কখন বাজবে আর কখন বাজবে না, এই সেটিংটা এখনও ঠিকঠাক হয়নি।

এবার বাইরে যাওয়ার পালা। কিন্তু এখানেও বিভ্রান্তি কম নয়। তীরচিহ্ন দিয়ে কোথাও লেখা আছে ব্লু লাইন, কোথাও আবার গ্রিন লাইন। এ দুটোর মানে কী, বোঝা মুশকিল। কাকে যে জিজ্ঞেস করি!‌ এসব ক্ষেত্রে বেশি বুদ্ধি অ্যাপ্লাই না করাই ভাল। সবাই যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকে হাঁটো। তাই হাঁটলাম। হেঁটেই চলেছি। কিন্তু এবার একদল দেখছি বাঁদিকে যাচ্ছে। একদল ডানদিকে। অনেক পরে বুঝলাম, যারা বাঁদিকে যাচ্ছে, তারা আরেকদফা পাতাল প্রবেশ করছে। অর্থাৎ, কেউ যাবে দমদমের দিকে। কেউ যাবে টালিগঞ্জের দিকে। অর্থাৎ, এক যাত্রায় এদের তৃষ্ণা মেটেনি। আমি বাপু এসবে নেই। আমি পাতাল থেকে মাটিতে উঠতে চাই।

বুঝলাম, আমার পথ অন্যদিকে। কিন্তু সামনে না পেছনে?‌ কোনটা ময়দান মার্কেটের দিকে যাচ্ছে, কোনটা মেট্রো সিনেমার দিকে যাচ্ছে, কে জানে। তীরচিহ্ন দিয়ে এটা–‌সেটা আঁকা আছে ঠিকই, কিন্তু গোলকধাঁধার নানা পাক খেয়ে যখন কিছুই আর মাথায় ঢুকছে না। ছেড়ে দে মা, একটু আকাশ দেশি। অবশেষে যেন সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে এলাম। ‘‌মাটির পৃথিবী পানে আঁখি মেলি যবে/‌ দেখি সেথা বিপুল জনতা চলে/‌ নানা পথে, নানা দলে দলে।’‌

গঙ্গার তলা দিয়ে আসার রোমাঞ্চ তখন অনেক পেছনে। যাক, ভালোয় ভালোয় পাতাল থেকে কল্লোলিনী তিলোত্তমাকে খুঁজে পেয়েছি, এই ঢের।

মহানগরীর কোলাহল আমি দেখিয়াছি। গঙ্গার তলায় যাইতে চাই না আর।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.