অজয় নন্দী
নিত্য নতুন বায়নায় মোহনবাগান সচিবের কোনও জুড়ি নেই। সেই বায়না কতটা হাস্যকর, সেদিকে কোনও ভ্রুক্ষেপই থাকে না। যেভাবেই হোক, খবরে থাকতে হবে। টিভিতে মুখ দেখাতে হবে। কাগজে নাম ছাপাতে হবে। তার জন্য মোহনবাগান হাস্যকর হল কিনা, এসব ভেবেও দেখেন না।
এক একটা চেয়ারের একেকটা ওজন আছে। অনেকেই সেই চেয়ারের মূল্য বোঝেন না। সেই চেয়ারের ওজন বোঝেন না। মোহনবাগান সচিব দেবাশিস দত্ত তেমনই একজন প্রচারসর্বস্ব কর্তা। আগে যেমন সস্তা নাটক করতেন, এখনও সেই সস্তা নাটকই চালিয়ে যান। মাস খানেক আগেই তিনি হঠাৎ করে বলে বসলেন কলকাতা লিগে খেলব না। এমনকী মোহনবাগান নাকি ঝাড়খণ্ড বা ওড়িশার অনুমোদন নিয়ে খেলব। ভাগ্যিস বলেননি উয়েফার অধীনে খেলব।
এবার ডার্বির আগে হঠাৎ করে তিনি সমর্থকদের ডার্বি বয়কটের ডাক দিয়ে বসলেন। যেন নেতাজি দেশবাসীকে ডাক দিচ্ছেন। এমন একটা ইস্যু, যেটাকে আলোচনা করে সহজেই মিটিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু তিনি তো ভাঁড়ামোতে বিশ্বাসী। তিনি তো গায়ে গা পেড়ে ঝগড়ায় বিশ্বাসী। সহজ ব্যাপারটা যদি সহজে মিটে যায়, তাহলে যে তাঁর ঘোলাজলে মাছ ধরা হবে না। তাহলে যে তাঁর খবরে থাকা হবে না।
এমনিতেই এবারের ডার্বি নিয়ে অনেক জটিলতা তৈরি হয়েছিল। হঠাৎ করে রাজ্যের শাসক দল ব্রিগেড সমাবেশ ডেকে দেওয়ায় পুলিশ দেওয়া নিয়ে সমস্যা। যদি উল্টোটা হত! অর্থাৎ, আগে তৃণমূলের সমাবেশের তারিখ ঘোষণা হয়ে গেল। তারপর বড় ম্যাচ আয়োজন করতে গেলে পুলিশ অনুমতি দিত! নিশ্চয় বলা হত, ওইদিন শাসকদলের সভা আছে, তাই অনুমতি দেওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে পুলিশ বলতে পারত, ওই দিন ডার্বি আছে, তাই ব্রিগেড সভার অনুমতি দেওয়া যাবে না। তার বদলে হল উল্টোটা। শাসক দল হঠাৎ করে সভা ঘোষণা করল, সেই কারণে অনেক আগে ঘোষিত ডার্বি নাকি করা যাবে না। দুই ক্লাবের কর্তারাই দন্ত বিগলিত করে মেনে নিলেন। একবারও বলতে পারলেন না, ডার্বির সূচি আগেই ঘোষিত, তাহলে সেটা পেছোবে কেন? এই যুক্তির কথা তুলে ধরলে বুঝতাম প্রতিবাদী। না, এতখানি মুরোদ মোহন সচিবের নেই।
তিনি বায়না ধরলেন ফালতু একটা বিষয় নিয়ে। ইস্টবেঙ্গলের টিকিট কেন কম দামের, আমাদের টিকিট কেন বেশি দামের? অতএব, আমরা টিকিট তুলব না। আমাদের সমর্থকরাও খেলা দেখবেন না। সমর্থকরে দেখবেন না দেখবেন না, সেই ব্যাপারে নিদান দেওয়ার তিনি কে? দেখা গেল, সমর্থকরা দিব্যি টিকিট তোলার জন্য লাইন দিয়েছেন। অর্থাৎ, জাতির উদ্দেশে তাঁর বার্তার কোনও প্রভাবই পড়ল না। তখন মুখ বাঁচাতে আসরে নামানো হল আরও এক প্রচারের কাঙাল ক্রীড়ামন্ত্রীকে। ডার্বি কোথায় হবে, তা নিয়ে এতদিন মুখ খোলার সাহস দেখাননি। পাছে দিদি ক্ষেপে যান! এখন যখন জট ছেড়েছে, সময় কিছুটা পিছিয়ে সেইদিনই ডার্বি আয়োজনের ব্যবস্থা হয়েছে, তখন তাঁকে প্রচারের ক্ষীর খেতে হবে। তিনি এবার নেমে পড়লেন ইস্টবেঙ্গলকে বোঝাতে। রফাসূত্র বেরোলো। কিন্তু নিট ফল তো একই থাকল।
এইসব প্রচারপ্রিয় মন্ত্রী আর কর্তারা না বোঝেন খেলা না বোঝেন সমর্থকদের আবেগ। যেনতেন প্রকারেণ তাঁদের প্রচারে থাকতে হবে। এখানে সেখানে মুখ বাড়িয়ে ছবি তুলতেই হবে।
মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, মোহনবাগান সচিব দিনের পর দিন এই জাতীয় সস্তা নাটক আর ভাঁড়ামি করে যাচ্ছেন কীসের ভরসায়? আসলে, স্বভাব। বহুকালের পুরনো স্বভাব। খবরে থাকার জন্য একেবারে নীচুস্তরের ভাঁড়ামি করতেও এঁদের আটকায় না। কেউ ইচ্ছে করলে নিজে ভাঁড় হতেই পারেন। কিন্তু মোহনবাগান সচিবের চেয়ারে বসে যে এমন ভাঁড়ামি করা যায় না, এটা বলার মতো ক্লাবে কেউ নেই! পাশে পেয়েছেন আরেক ভাঁড়কে। যিনি শুধুমাত্র মুখ্যমন্ত্রীর ভাই হওয়ার সুবাদে মোহনবাগানের মতো ক্লাবের ফুটবল সচিব হয়ে বসে আছেন। একসময় যে ফুটবল সচিব ছিলেন শৈলেন মান্না, এমনকী কয়েক বছর আগেও যে চেয়ারে বসতেন সত্যজিৎ চ্যাটার্জি, সেই চেয়ারে আজ বাবুন ব্যানার্জি। আসলে, এই বাবুন ব্যানার্জিদের ফুটবল সচিব না করলে দেবাশিসবাবুরা যে সচিব থাকবেন না।
দোষটা একা তাঁদের নয়। আসলে, মূলস্রোত মিডিয়াও বড় বেশি অসহায়। দন্ত বিগলিত করা রিপোর্টারকূলে ছেয়ে গেছে ময়দান। সচিবও হ্যাংলার মতো সেলফি তোলেন। রিপোর্টারাও সমগোত্রীয়। বলিষ্ঠ কলম হাতে একটা ধীমান দত্তর আজ সত্যিই বড় দরকার ছিল। তাঁর কলমই এই প্রশ্নটা তুলতে পারত, রাজা তোর কাপড় কোথায়!
