দশ বছর আগে, মহানায়ক অরূপ কুমারের সঙ্গে

সরল বিশ্বাস

বছর দশেক আগের কথা। সেবারও লোকসভা ভোটের আবহ। অফিস থেকে পাঠাল বাঁকুড়ায়। সেখানে ভোটের হাওয়া পরখ করতে।

বাঁকুড়ায় সেবার হেভিওয়েট লড়াই। একদিকে বাসুদেব আচারিয়া। তৃণমূলের প্রার্থী মুনমুন সেন। বিজেপির সুভাষ সরকার। বোঝাই যাচ্ছিল, বিজেপির ডাক্তারবাবু বেশ ভাল ভোট কাটবেন। বিরোধী ভোটে ভাগ বসাবেন। সেই অঙ্কে হয়তো জিতে যাবেন মুনমুন সেন।

কিন্তু গিয়ে বুঝলাম, মুনমুন সেন নামেই প্রার্থী। তিনি এলাকার কিছুই চেনেন না। তাঁর ভোট ম্যানেজার আসলে জেলা পরিষদের সভাপতি অরূপ চক্রবর্তী। মুনমুনের সঙ্গে তাঁর ছবির কাট আউটে বাঁকুড়া শহর ছেয়ে গেছে। নানা ভঙ্গিমায় পোজ দিয়ে তোলা ছবি। কোথাও তিনি সাদা জ্যাকেট পরে। কোথাও তিনি পাজামা–‌পাঞ্জাবি পরে। বোঝাই গেল, বেশ বর্ণময় চরিত্র।

মনে হল, লোকটা কে তো একটু কাল্টিভেট করতে হচ্ছে। মানে, এই লোকটার সঙ্গে কথা না বলে কলকাতা ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না। কখনও গাড়ির ড্রাইভার, কখনও হোটেলের কর্মী, কখনও বিভিন্ন দোকানি। অনেকের মুখেই তাঁর কথা। কেউ বলছেন, লোকটা আসলে মাফিয়া। কেউ বলছেন, একটু গ্যাস খেতে ভালবাসে। কেউ বলছেন, লোকটা একটু ছবি টাঙাতে ভালবাসে, কিন্তু মনটা ভাল। কেউ বললেন, মুনমুন সেনের পেছনে সেঁটে আছে, ধারেকাছে কাউতে ঘেঁসতে দিচ্ছে না।

বুঝলাম, লোকটা বিত্তশালী। লোকটা প্রভাবশালী। বুঝলাম, এইমুহূর্তে জেলার তৃণমূলটাকে এই ভদ্রলোকই চালাচ্ছেন। ডিএম–‌এসপি তাঁর কথাতেই ওঠাবসা করেন। ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন করেই বসলাম। বললাম, কাল সকালে একটু দেখা করতে চাই। উনি প্রথমে একটু ভাও দেখালেন। বলেলন, ‘‌কাল মিটিং আছে। অন্যদিন আসুন।’‌ এমন কথা কত শুনেছি। কীভাবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়, ততদিনে ভালই শিখে গেছি। বললাম, ‘‌বাঁকুড়ায় এসেছিলাম ইলেকশন কভার করতে। কিন্তু নানা জায়গায় ঘুরে যা বুঝলাম, আপনিই হলেন আসল লোক। ক্যান্ডিডেট না হলেও আসল ক্যান্ডিডেট আপনিই। কলকাতার অফিসও বলে দিয়েছে, আপনিই হলেন বাঁকুড়ার আসল লোক। আপনার সঙ্গে যেন অবশ্যই দেখা করে আসি।’‌ কাজ হচ্ছে। তিনি তখন গ্যাসে বিগলিত হচ্ছেন। পরের দিন সকালে সময় দিয়েই দিলেন।

সকাল আটটায় স্কুলডাঙায় তাঁর বাড়িতে যেতেই দেখা গেল একঘর লোক। জেলার নানা প্রান্ত থেকে এসেছেন। তিনি একেকারে দরবার সাজিয়ে বসেছেন। পরিচয় দিতেই নিয়ে গিয়ে বসালেন পাশের ঘরে। বাইরের হলঘর সামলানোর দায়িত্ব অন্য এক অনুগামীকে দিয়ে এলেন ‘‌সাক্ষাৎকার’‌ দিতে।

কয়েকটা সংলাপ তুলে দেওয়া যাক।
আমি— সবার মুখেই তো ঘুরেফিরে আপনার কথা। সবাই বলছে, আপনারই প্রার্থী হওয়া উচিত ছিল।
অরূপ— কী যে বলেন!‌ দিদিও বলেছিল, তোকেই দিল্লি পাঠাতাম। কিন্তু তুই চলে গেলে এতবড় জেলাটা কে সামলাবে!‌ এই জেলায় এত কাজ করতে চাইছি। তোকেই তো এইসব উন্নয়নের কাজ করতে হবে। এখানে একজন অনেস্ট লোক দরকার। এমপির আর কাজ কী?‌ সেজেগুজে দিল্লি যাওয়া। তোর কাজ হবে জেলাটাকে নতুন করে গড়ে তোলা।
আমি— আপনাকে দিদি তাহলে খুব ভরসা করেন!‌
অরূপ— হ্যাঁ, তা করেন বইকি। এই যে আমার জেলায় এতগুলো এমএলএ। সবগুলো একেকটা — (‌লেখা গেল না)‌। ওদের দিয়ে কিস্যু হবে না। এটা দিদি বোঝেন। তাই তো আমাকেই পুরো দায়িত্ব দিয়েছেন। এই যে ইউনিভার্সিটি হচ্ছে। পুরো জমিটা আমি দিয়ে দিলাম। আর কেউ দিতে পারবে?‌ দিদি বলে দিয়েছে, মুনমুন সেনকে জেতানোর দায়িত্ব তোর।

মাঝে মাঝেই ফোন আসছে। কখনও কেটে দিচ্ছেন। কখনও ধরছেন। এক বিধায়কের ফোন এল। একটু সময় চেয়ে নিলেন। ওদিকে, সেই বিধায়ক কী বলছেন, শোনা গেল না। তবে এদিকের উত্তর শুনে বেশ বোঝা গেল। এদিকের উত্তরগুলোই তুলে ধরা যাক।

— ওরে হব্যাক হব্যাক। চিন্তা করিস না। পরশু ক্যান্ডিডেট আসবেক। কুথায় কবে প্রোগ্রাম, ঠিক হোক।

— ওরে, তোর এলাকায় নিশ্চয় যাবেক। তাই কি না যায়‌!‌ আগে ইদিকটা হইয়ে যাক।

— কী বললি, মুনমুন সেনকে তোর ঘরে খাওয়াবি!‌ এখন থিসে এত মাতিস না। তুর ঘরে গেলে বাকিরা কী দোষ করল!‌ বাকি লোকগুলা তখন ঝুঁক ধরব্যাক, তাদের ঘরেও খা’‌তে হব্যাক। মুনমুন সেন কি সবার ঘরে খাইয়ে বেড়াবেক?‌ তাহলে পচারটা করবেক কখন?‌

— ও। তুর অনেক আশা ছিল?‌ ত, আশাটা তো পালাই যাচ্ছে নাই। একবার ভাল করে জিতা। তারপর পাঁচ বছর তো ইখানকার এমপি থাকবেক। তখন তো বারবার আসবেক। তখন তুর ঘরে খাওয়াই দুব।

— ও, মুনমুন হ’‌ল। ইবার রিয়া–‌রাইমাকে চাই। শালা। তুদের লোভের শেষ নাই। কুনদিন বলববি মাধুরী দীক্ষিৎকে তুর ঘরে খাওয়াবি। শালা, উয়ারা কী খায় জানিস?‌

— হ্যাঁ, কী বললি?‌ মিঠুনকে লিয়ে যাব?‌ মিঠুন কি আমার বাবার চাকর বটে!‌ উটা দিদি দেখছে। কাকে কখন কুথায় পাঠাবেক। মুনমুন সেনেরটা আমি ঠিক করব। মিঠুন, দেব ইয়ারা কে কবে আসবেক, সব উপর থিকে ঠিক হবেক। উটায় আমার কিছু করার নাই। যদি তুর উখানে হয়তো, হব্যাক। চিন্তা করিস না, কেউ না কেউ যাবেন। যত খুশি ছবি তুলে লিবি। ঘরে টাঙাই রাখবি। এখন ঘরে টাঙা। পরে তুর ঘরে খাওয়াই দুব।
****
ফোন পর্ব শেষ হল। তারপর হেঁসে বললেন, ‘‌দেখলেন তো। সবাই চাইছে মুনমুন সেনকে তার বাড়িতে খাওয়াতে। আমি আমার বাড়িতেই এখনও খেতে বলিনি। আগে ভোট পেরিয়ে যাক। তারপর দেখা যাবে।’

‌আগেরদিন যাওয়া হয়েছিল ছঁাদারের দিকে। সেখানে গিয়ে শোনা গেল হাতির হানার কথা। হাতির আতঙ্কে সন্ধে থেকে মানুষ নাকি বাইরে বেরোতেই পারছে না। রাতের বেলায় হাতির দল এসে ঘর ভেঙে দিচ্ছে। একে–‌তাকে মেরে ফেলছে। আতঙ্কে রাতে পাহারা দিচ্ছে গ্রামবাসী।

একটা সিগারেট ধরিয়ে আলতো একটা হাসি হাসলেন অরূপ কুমার। একটা টান দিয়ে বললেন, ওটার সমাধান করে ফেলেছি। পরেরবার আসবেন। দেখবেন, আর কোনও হাতি আসছে না।

— সে কী?‌ হাতিকেও বশ করে ফেলেছেন?‌
অরূপ কুমার:‌ আপনারা আসল কারণটা বুঝছেন না। অবশ্য আপনাদের আর দোষ কী?‌ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টই ভাবেনি। ডিএম–‌এসপিরাও ভাবেনি।
— আসল কারণটা তাহলে কী?‌
অরূপ কুমার:‌ হাতি কেন বাইরে আসে বলুন তো?‌ ওর কি শখ যায়?‌ আসলে, জঙ্গলে ও ঠিকমতো খাবার পায় না। সেই কারণেই বাইরে চলে আসে। এটা আটকানোর একটাই উপায়। জঙ্গলে ওর খাবারের ব্যবস্থা করা। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, হাতি কলা গাছ খেতে খুব ভালবাসে। ডিএম–‌কে বললাম, জঙ্গলের ভেতর দশ লাখ কলা গাছ লাগিয়ে দিন। হাতি কত খাবে, খাক। আর ওর বাইরে আসার দরকারই হবে না।
— এটা তো দারুণ আইডিয়া। এটা তো ডুয়ার্সেও ফলো করতে পারে। ওখানেও তো খুব হাতির উৎপাত।
ফের একটা যুদ্ধজয়ের হাসি হাসলেন মহানায়ক অরূপ কুমার। আরেক টান দিয়ে বললেন, ‘‌এই আইডিয়াটা বলতেই ডিএম চমকে গেল। বলল, আপনি যেটা ভেবেছেন, এটা কেউ ভাবতে পারেনি। শুধু ডুয়ার্স কেন, দেখতে থাকুন। সারা দেশে এটা চালু হয়ে যাবে। হাতে তো সব জায়গাতেই এমন প্রবলেম করে। দিদিকে বলেছি। দিদি তো দারুণ খুশি। ভাবতে পারছেন, হাতির এই প্রবলেম আটকাতে পথ দেখাবে বাঁকুড়া।

— যেদিকে যাচ্ছি, শুধু আপনার ছবি। নানা ভঙ্গিমায়।
অরূপ কুমার: কে কোথায় কী ছবি টাঙিয়ে দিচ্ছে। সবার হাতেই ফোন। যে পারছে ছবি তুলছে। ফ্লেক্স বানিয়ে দিচ্ছে। লোকে যদি ভালবেসে টাঙায়, আমার কী করার আছে?‌ কজনকে বাধা দেব?‌ যে যা পারছে করুক। খারাপ তো করছে না।

— কিন্তু আপনার নামে তো কয়লা পাচার থেকে শুরু করে নানা অভিযোগ উঠছে। বাসুদেব আচারিয়া তো বললেন, আপনিই এর পান্ডা।
অরূপ কুমার:‌ বাসুবাবু এই কথা বলছে নাকি!‌ তাহলেই ভাবুন, আমি কোথায় পৌঁছে গেলাম। সবাই মিলে আমাকে হিরো বানিয়ে দিল। বাসুবাবু আমার নামে কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি লিখছে। আমার স্ট্যান্ডার্ডটা কোথায় পৌঁছে গেল, ভেবে দেখেছেন!‌ আসলে, কী জানেন তো, ঈর্ষা। আমাকে সবাই ভালবাসে। এত এত মানুষ করে খাচ্ছে। এটা ওদের পছন্দ হচ্ছে না। আরে বাবা, আমি তো ক্যান্ডিডেট নই। আমার নামে এত বলার কী আছে!‌

এভাবেই কথাবার্তা চলতে লাগল। একের পর এক স্মরণীয় বাণী উপহার দিয়ে গেলেন অরূপ কুমার। সেবার মুনমুন জিতলেন। বছর পাঁচেক সত্যিই তাঁকে একরকম আগলে রাখলেন অরূপ কুমার। সাংসদ কোথায় যাবেন, কোথায় যাবেন না, কী বলবেন, সবই ঠিক করতেন তিনি। এরই মাঝে ২০১৮–‌র পঞ্চায়েত ভোট, সভাধিপতি সিট হয়ে গেল এসটি সংরক্ষিত। ফলে, তাঁর আর সভাপতি হওয়া হল না। ২০১৯ এ টিকিট পেলেন না। পাঠিয়ে দেওয়া হল সুব্রত মুখার্জিকে। ২০২১ এ বিধানসভায় টিকিট পেলেন তালডাংরায়। এবার দীর্ঘ আড়াই দশক পর আবার ভূমিপুত্রে ভরসা রেখেছে তৃণমূল। অবশেষে শিঁকে ছিড়ল মহানায়ক অরূপ কু্মারের।

এখন আবার সাক্ষাৎকার নিতে গেলে তিনি কী বলবেন, জানা নেই। তবে, দশ বছর আগের সেই স্মৃতি কিছুটা তুলে ধরা গেল। যা বোঝার বুঝে নিন।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.