একটি দলবদল ও কয়েকটি মোক্ষম থাপ্পড়

সরল বিশ্বাস

কেউ এক দল থেকে অন্য দলে গেলে কয়েকটা চেনা সংলাপ ঘোরাফেরা করে। তৃণমূল থেকে যদি কেউ বিজেপি–‌তে যান, তিনি বলবেন, ‘‌এই দুর্নীতি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। দম বন্ধ হয়ে আসছিল।’

আর যদি কেউ বাম বা বিজেপি বা কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে আসেন, তাহলে তিনি বলবেন, ‘‌বিরোধী থেকে কাজ করতে পারছিলাম না। রাজ্যে যে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ চলছে, তাতে সামিল হলাম।’‌ ‌

ভোটের বাজনা বাজলেই এই আসা–‌যাওয়ার পর্বটা বেড়ে যায়। বানর যেমন এই ডাল থেকে ওই ডালে ঝাঁপ দেয়, এই দল থেকে ওই দলে ঝাঁপ দেওয়ার পর্বটাও সেইরকম।

এবার মুকুটমণি অধিকারী। এমনিতে খুব একটা পরিচিত নাম নয়। ‌বিশেষ করে জেলার রাজনীতির খোঁজখবর যাঁরা রাখেন না, তাঁদের কাছে অনেকটাই অপরিচিত। তিনি রানাঘাট দক্ষিণের বিজেপি বিধায়ক। হঠাৎ করে দেখা গেল, তৃণমূলের মিছিলে হাঁটছেন। পরে তাঁর হাতে পতাকাও ধরিয়ে দেওয়া হল।

পাঁচ বছর আগের ছোট্ট একটা ঘটনা এই সুযোগে বলে নেওয়া যাক। ২০১৯–‌র লোকসভায় রানাঘাট থেকে বিজেপি প্রার্থী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তখন ছিলেন সরকারি চিকিৎসক। ফলে, ভোটে দাঁড়াতে গেলে পদত্যাগ করতে হত। কিন্তু স্বাস্থ্যদপ্তর নানা টালবাহানা করে তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করল না। ফলে, সে যাত্রায় আর ভোটে দাঁড়ানো হল না। বিকল্প প্রার্থী হিসেবে জগন্নাথ সরকারের নাম ঘোষণা হল। জিতেও গেলেন। ২০২১–‌র বিধানসভার আগে অবশ্য আগেভাগেই পদত্যাগ করেন। ফলে, দাঁড়াতে সমস্যা হয়নি। জিতে বিধায়কও হলেন।

চারদিন আগেও ছিলেন নরেন্দ্র মোদির সভায়। হঠাৎ তৃণমূলে কেন?‌ আসলে, ভেবেছিলেন, বিজেপি থেকে লোকসভায় টিকিট পাবেন। কিন্তু প্রার্থী হিসেবে ফের ঘোষণা হল জগন্নাথ সরকারের নাম। অতএব গোঁসা হল। গোঁসা হলে প্রথমে যা হয়!‌ বললেন, ‘‌এই প্রার্থী দিয়ে ভোটে জেতা যাবে না।’‌ কিন্তু ঘোষণা তো হয়ে গেছে। বদল হওয়ার সম্ভাবনাও কম। অতএব, শিবির বদল করো।

প্রার্থী হতে পারিনি, তাই তৃণমূলে এসেছি, এমনটা তো বলা যায় না। তাহলে!‌ দলবদল করে সবাই যা বলে, তিনিও মোটামুটি সেই বাঁধা গতেই হাঁটলেন। ‘‌নদিয়া জেলার উন্নয়ন হয়নি। বিধায়ক থেকে উন্নয়নের কাজ করতে পারছিলাম না। তাই শাসকদলে যোগ দিলাম।’‌

যাঁরা পরম আনন্দে অন্য দল থেকে ভাঙিয়ে এনে হাতে পতাকা ধরিয়ে দেন, তাঁরা ভেবেও দেখেন না, এই জাতীয় স্বীকারোক্তির মধ্যে কতখানি থাপ্পড় মেশানো আছে। একজন বিধায়ক বলছেন, নদিয়া জেলায় কোনও উন্নয়ন হয়নি। থাপ্পড়টা কার গালে লাগল?‌ একজন বিরোধী বিধায়ক বলছেন, ‘‌বিরোধী হয়ে কাজ করতে পারছিলাম না।’‌ কাজ করতে বাধাটা কে দিচ্ছিল?‌ একটা সরকারের পক্ষে এটা কতটা লজ্জার, এটুকু বোঝার মতো বোধবুদ্ধিটাও থাকে না।

অনেকে মুকুটমণিবাবুকে গালমন্দ করবেন। কেউ ধান্দাবাজ বলবেন। কেউ হয়তো পাল্টিবাজ বলবেন। কিন্তু শাসকদলের ‘‌সেনাপতি’‌র পাশে দাঁড়িয়ে এতবড় সত্যিটা বলার জন্য তাঁর সাহসের তারিফ করবেন না?‌ দলবদলের পুরস্কার কী হতে পারে?‌ হতে পারে, রানাঘাটে তাঁর নামই তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা হল। অথবা, প্রার্থী করা হল না। কিন্তু শাসক দলে আসার সুবাদে প্রভাব অনেকটা বাড়বে। আগে থানার ওসি পাত্তা দিতেন না, এখন এসপি তাঁর কথা শুনে চলবেন।

১)‌ যদি টিকিট পান, তাহলে কী বার্তা যাবে?‌ বিরোধী থেকে শাসক দলে এলেই টিকিট পাওয়া যায়, এমন প্রত্যাশা যদি থেকে থাকে, তাহলে তৃণমূলকে তিনি কতখানি সস্তা দল মনে করেন, একটু ভেবে দেখুন।
২)‌ একদলের নির্বাচিত বিধায়ক। অন্য দলে যোগ দিতে হলে তো পদত্যাগ করতে হয়। কদিন আগেই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তাপস রায়। আগে পদত্যাগ করেছেন, তারপর বিজেপির পতাকা ধরেছেন। কিন্তু মুকুটমণিবাবু জানেন, তৃণমূলে যেতে গেলে এসব নৈতিকতা মানার কোনও দায় নেই। এটা আরেকটা সপাটে থাপ্পড়।
৩)‌ যদি হয়তো টিকিট পেলেন না, বিধায়কই থেকে গেলেন। তিনি নিশ্চিত, তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে না। তিনি নিশ্চিত, বাংলার বিধানসভায় ‘‌দলত্যাগ বিরোধী আইন’‌কে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলেছেন স্পিকার। তিনটে টার্ম মিলিয়ে অন্তত সত্তরজন বিধায়ক দলত্যাগ করে শাসক দলে এসেছেন। কিন্তু সদস্যপদ যায়নি। তাঁরও যাবে না। এটা কার গালে থাপ্পড়?‌ ভারতে আর কোন রাজ্যের স্পিকারের প্রতি ‘‌দলবদলু’‌রা এতখানি আস্থা রাখতে পারেন!‌

একটা ছোট্ট দলবদল। কতগুলো মোক্ষম থাপ্পড়ই না দিয়ে গেল!‌

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.