‌বিকল্পের কোনও পরিশ্রম নেই

সরল বিশ্বাস

শিরোনামটা দেখে ঘাবড়ে যাওয়ারই কথা। মনে হতেই পারে, নির্ঘাত ভুল টাইপ হয়েছে। এতকালের চেনা প্রবাদের সঙ্গে তো মিলছে না।

এ যেন খেলার আগেই হার স্বীকার করে নেওয়া। কয়েক মাস আগেও ঘটা করে যে ইন্ডিয়া জোটের কথা শোনা যেত, এখন আর সেভাবে শোনা যায় না। কোনও কোনও রাজ্যে হয়তো আসন সমঝোতা হবে। নাম কে ওয়াস্তে দু–‌একটা সভাও হবে। কিন্তু বিজেপি–‌র বিরুদ্ধে যে ঐক্যবদ্ধ লড়াই ছুড়ে দেওয়া যাবে না, সেই দেওয়াল লিখন এর মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেছে।

গণতন্ত্রের স্বার্থেই শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা খুব জরুরি। বিরোধীরা শক্তিশালী থাকলে সরকার যেমন কিছুটা সতর্ক থাকে। জনসমর্থন হারানোর ভয় থাকে। তেমনি জনগণের সামনেও বিকল্প থাকে। সরকারকে সরাতে চাইলে তাঁরাও বিকল্প বেছে নিতে পারেন। কিন্তু বিরোধীরা একে দুর্বল, তার ওপর ছত্রভঙ্গ। ফলে, জনতা কাদের ওপর ভরসা করবে?‌

নানা আঞ্চলিক দল। তাদের নানা রকম স্বার্থ জড়িয়ে আছে। একেক রাজ্যে একেক রকম সমীকরণ। এইসব দলগুলির এক ছাতার তলায় আসা এমনিতেই কঠিন। তামিলনাড়ুতে যেমন ডিএমকে–‌এআইএডিএমকে–‌র এক ছাতার তলায় আসা সম্ভব নয়। বাংলায় তেমনি বামফ্রন্ট–‌তৃণমূলেরও এক ছাতার তলায় আসা সম্ভব নয়। তাছাড়া, কংগ্রেস শক্তিশালী হলে তাকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক দলগুলির একটি জোট হতে পারত। কিন্তু কংগ্রেস দুর্বল হলে আঞ্চলিক দলগুলি উল্টে কংগ্রেসকেই আরও চাপে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কংগ্রেসের জমিদারি মানব না, এটাই যেন অলিখিত স্লোগান হয়ে দাঁড়ায়। এই পারস্পরিক অবিশ্বাসের আবহে জোট হওয়া সত্যিই বেশ কঠিন।

আরও একটি কারণ, এই আঞ্চলিক দলগুলির অধিকাংশই কোনও না কোনও সময়ে বিজেপির শরিক ছিল। বাম ও লালু প্রসাদ যাদব ছাড়া কোনও দলেরই সেই রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। এঁরা প্রায় সবাই নানা সময়ে বিজেপির সঙ্গে ছিলেন। এখনও বিজেপি–‌র সঙ্গে তেমন আদর্শগত বিরোধ নেই। নেহাত বিজেপি শিবিরে পাত্তা পাচ্ছেন না, তাই এদিকে আছেন, এমন দলের সংখ্যাও কম নয়। আগামীদিনে প্রয়োজন পড়লে আবার বিজেপি শিবিরে নৌকো ভিড়িয়ে দিতেই পারেন। নীতীশ কুমার তো আগেই সরে পড়লেন। আরও কারও কারও সরে পড়া সময়ের অপেক্ষা।

তাহলে বিজেপির সঙ্গে লড়াইয়ের কোনও উপায়ই কি ছিল না?‌ ওয়াক ওভার দেওয়াই কি অনিবার্য নিয়তি ছিল?‌ এইমুহূর্তে যা অবস্থা, তাতে বিজেপি–‌কে হারানো হয়তো কঠিন। তবে ঠিকঠাক লড়তে পারলে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া যেত। জোট যদি করতেই হত, সেই প্রক্রিয়া অনেক আগে শুরু করা দরকার ছিল। অন্তত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার পর থেকেই নেমে পড়া যেত। শুধু লোক দেখানো কয়েকটা বৈঠক, পাশাপাশি বসে ফটোসেশন। এগুলো যথেষ্ট নয়। এতে প্রচার হয়। ছবি ওঠে। সমন্বয় গড়ে ওঠে না। তাছাড়া, একটা বৈঠকের পরের বৈঠক তিন মাস পর। আগের বৈঠক কবে হয়েছে, লোকে ভুলেই গেছে।

বৈঠকের নির্যাস কী?‌ গোটা কয়েক প্রেস কনফারেন্স। এই লড়াইকে মঞ্চেও আনা গেল না। রাস্তায় নামানো তো অনেক দূরের কথা। বিভিন্ন দলের কর্মীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটবেন, একসঙ্গে আন্দোলনে নামবেন, সেই পরিস্থিতি পর্যন্ত গড়ালই না। সবার চোখ আসন সমঝোতায়। একদিকে কংগ্রেস চাইল, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানা ভোট পর্যন্ত বিষয়টাকে ঝুলিয়ে রাখতে। তাঁরা ভেবেছিলেন, এই চারটের মধ্যে যদি তিনটেয় সরকার হয়ে যায়, তাহলে তাঁরাই হবেন জোটের চালিকাশক্তি। তাঁরাই আসনরফা চূড়ান্ত করবেন। বাকিরা সেটা মেনে নেবেন। অন্যদিকে, আঞ্চলিক দলগুলি ভাবল, ওই চার রাজ্যে ভাল ফল হলে, কংগ্রেস কাউকে পাত্তাই দেবে না। তাই এই সুযোগে কংগ্রেসকে চাপে রেখে আসন সমঝোতা হয়ে যাক। ফল কী হল?‌ তিন রাজ্যে কার্যত ভরাডুবি। জোটে আরও যেন কোণঠাসা হয়ে পড়ল কংগ্রেস।

যেমন, বাংলার কথাই ধরা যাক। তৃণমূলের সঙ্গে জোট হবে কিনা, কংগ্রেসকর্মীরা আগাগোড়াই ধোঁয়াশায় রইলেন। এমনকী রাজ্য সভাপতি অধীর চৌধুরি পর্যন্ত ধোঁয়াশায় রইলেন। না তৃণমূলের পাশে দাঁড়ানো যাচ্ছে, না আক্রমণ করা যাচ্ছে। বামেদের ক্ষেত্রে তৃণমূলের সঙ্গে জোটের সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু কংগ্রেসের সঙ্গে জোট নিয়ে ধোঁয়াশা। কারণ, তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট হলে, বামেদের একাই লড়তে হত। আবার তৃণমূল–‌কংগ্রেস জোট না হলে বাম–‌কং জুটি হতে পারে। আগে থেকে ছবিটা পরিষ্কার হলে অন্তত বাম–‌কং জোটকে আরও আগে থেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেত। এতে বিজেপি বিরোধী সংখ্যালঘু শিবিরে যেমন কিছুটা আস্থা অর্জন করা যেত, তেমনই তৃণমূল বিরোধী ভোটারদের বিজেপিমুখী স্রোত একটু হলেও আটকানো যেত। বেশ কিছু যৌথ কর্মসূচি হতে পারত। এতদিনে আসনরফাও চূড়ান্ত হয়ে যেতে পারত। গোটা ব্যাপারটা অহেতুক ঝুলে রইল। কেন সীতারাম ইয়েচুরি মমতার সঙ্গে মিটিং করলেন, এই অভিযোগের জবাব দিতে দিতেই রাজ্য নেতাদের কয়েক মাস কেটে গেল। এই সুযোগটাই নিল বিজেপি। নীচুতলায় যাঁরা সত্যিকারের তৃণমূল বিরোধী, তাঁদের মধ্যেও বামেদের তৃণমূল বিরোধী অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হল।

শাসকদলের কোন ইস্যুকে কীভাবে কাউন্টার করা হবে, কোন ইস্যুটাকে উপেক্ষা করা হবে, এই রণনীতি তৈরিই করা গেল না। ফলে, একদিকে মোদি যখন রাম মন্দিরের হাওয়া তুলছেন, বিরোধীরাও মন্দিরে যাওয়া শুরু করে দিলেন। কে কত রামভক্ত, তা প্রমাণ করার যেন হিড়িক পড়ে গেল। ফলে, বিজেপি যে হাওয়ায় দেশকে ভাসাতে চেয়েছিল, বাকিরাও যেন তাতে পালে হাওয়া দিল। বিরোধীরা কী কর্মসূচি নেবে, তার নিয়ন্ত্রক যেন বিজেপি।

সহজ কথা, জোট করতে গেলে, যে আন্তরিকতা দরকার, তা কোনও পক্ষেরই ছিল না। যে আত্মত্যাগ দরকার, তার জন্যও কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। যে বিশ্বাসযোগ্যতা দরকার, তাও অধিকাংশ দলেরই নেই। মোদ্দা কথা, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও পরিশ্রম। কোনওটাই ছিল না। আদ্যোপান্ত ফাঁকিবাজি আর ফটোসেশন দিয়ে শাসকদলকে হারানো দিবাস্বপ্নের মতোই।

ছোট থেকেই শুনে আসছি, পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। বিরোধী জোটের দায়সারা মনোভাব ও কাণ্ড কারখানা দেখেই শিরোনামটা উল্টে দেওয়া। বলতেই হচ্ছে, বিকল্পের কোনও পরিশ্রম নেই। ‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.