হ্যাঁ, রাজ্যসভা শমীকবাবুদেরই জায়গা, আকাট মূর্খদের নয়

ওপেন ফোরাম

 

অজয় কুমার

সিগারেটের প্যাকেটে একটা বিধিসম্মত সতর্কীকরণ লেখা থাকে। তেমনই শুরুতেই স্বীকার করে নেওয়া ভাল, আমি মোটেই বিজেপি নই। সদস্যও নই, সমর্থকও নই। কোনও স্তরের নির্বাচনে এই দলকে ভোট দিইনি। আমি মোদিরও সমর্থক নই, রামমন্দিরেরও সমর্থক নই।

কিন্তু তারপরেও বিজেপি–‌র একটি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। ‌রাজ্যসভায় তারা মনোনয়ন দিয়ে শমীক ভট্টাচার্যকে। এই রাজ্যের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে মনে করি, শমীক ভট্টাচার্যের মতো মানুষদেরই রাজ্যসভায় যাওয়া উচিত।

বিধানসভার যা আসন বিন্যাস, তাতে তৃণমূল থেকে যাওয়ার কথা চারজনের, বিজেপি থেকে একজনের। তৃণমূলের তালিকা প্রকাশিত হল দুপুরে। বিকেল নাগাদ জানা গেল বিজেপি প্রার্থীর নাম। তৃণমূলের তালিকায় কিছুটা চমক, কিছুটা অঙ্ক। তবে, চারজনের মধ্যে আদি তৃণমূল কেউ নন। রাজনীতির লোক বলতে একজনই, সুস্মিতা দেব। তিনিও কনভার্টেড তৃণমূল। সন্তোষমোহন দেবের কন্যা। কয়েক বছর আগেও ছিলেন কংগ্রেস সাংসদ। হেরে গিয়ে নাম লিখিয়েছিলেন তৃণমূলে। মমতাবালা ঠাকুর। মূল পরিচয়, মতুয়া বাড়ির প্রতিনিধি। রাজনৈতিক জ্ঞান সম্পর্কে যত কম বলা যায়, ততই ভাল। নাদিমুল হক। আগেও দু’‌বার রাজ্যসভায় ছিলেন। তারপরও তৃণমূল যত, ব্যবসায়ী তার থেকে বেশি। ২০১১–‌র আগে তৃণমূল নেতা হিসেবে নাদিমুল হকের নাম কেউ শুনেছিলেন!‌ সাগরিকা ঘোষ। ঘোষণার দিন পর্যন্ত তিনি নিজেই জানতেন না, তিনি তৃণমূল। তবে বলতে–‌কইতে পারেন, অন্তত লেখাপড়াটুকু আছে।

শমীক ভট্টাচার্যকে চিনি দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। দুরন্ত বক্তা। পড়াশোনা আছে। রসবোধ আছে। তার থেকেও বড় কথা, এতদিনের রাজনৈতিক জীবনে একটিও অসংলগ্ন কথা বলেছেন বলে মনে পড়ছে না। শালীনতার মাত্রা বজায় রেখেও রাজনৈতিক আক্রমণ করা যায়, বাংলার রাজনীতিতে শমীকবাবু অবশ্যই তার বড় একটা উদাহরণ।

কেন জানি না, দলবদলুদের ঠিক মেনে নিতে পারি না। যিনি যে দলের, সেই দলটাই মন দিয়ে করুন, কোনও সমস্যা নেই। ‘‌মানুষের কাজ’ করতে এত দল বদল করতে হয় কেন, বুঝি না। যে কারণে, জয়প্রকাশ মজুমদারদের থেকে মদন মিত্রদের বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।‌ যে কোনও মানুষেরই রাজনৈতিক সততাটা খুব জরুরি। যেমন জরুরি বিষয় হল পড়াশোনা ও মাত্রাজ্ঞান। শমীকবাবু দল বদলাতে পারেন, এমন গুঞ্জন কখনও শুনেছেন?‌ যে তৃণমূল দল ভাঙানোয় এত পটু, তাঁরা কি শমীককে দলে টানার চেষ্টা করেনি? নিশ্চিতভাবেই তাঁর কাছেও প্রস্তাব গিয়েছিল। তাছাড়া, তিনি নিজেও যদি একবার আগ্রহ দেখাতেন, ক্যাবিনেটে জায়গা বাঁধা ছিল। লোকসভা বা রাজ্যসভাতেও যেতেই পারতেন। কিন্তু ‘‌সওদা’‌ করেননি। এখনকার বাজারে এটাও কম কথা নয়।

আচ্ছা, রাজ্যসভা কাদের জন্য?‌ একটা কথা খুব পরিষ্কারভাবেই বলা দরকার, আর যাদের জন্যই হোক, মূর্খদের জন্য নয়। কিন্তু গত এক দশকের বেশি সময় ধরে আমাদের রাজ্য থেকে যাঁরা লোকসভা বা রাজ্যসভায় যাচ্ছেন, তাঁদের লেখাপড়ার হাল দেখলে সত্যিই বড় করুনা হয়। ‘‌লেখাপড়া’‌ মানে শুধু ডিগ্রি নয়, রাজনৈতিক বোধ ও বিচক্ষণতা। হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশের মধ্যে পঞ্চায়েত সদস্য হওয়ার মতো যোগ্যতাও নেই। এঁদের সাংসদ ভাবতে সত্যিই লজ্জা হয়। যাঁরা এঁদের নির্বাচন করেন, তাঁদের প্রতি আরও রাগ হয়। যাঁকে খুশি লোকসভা–‌রাজ্যসভায় পাঠিয়ে দেওয়া যায়, এমন ভাবার সাহসটা তাঁরা পেলেন কীভাবে?‌ তখন রাগ হয় রাজ্যের দন্ত বিগলিত করা মিডিয়ার ওপর। মূলস্রোত মিডিয়া নখদন্তহীন বলেই দলগুলি অর্বাচীনদের মনোনয়ন দেওয়ার সাহস পায়।

যেমন, বিজেপির কথাই ধরা যাক। আগেরবার তারা মনোনয় দিল অনন্ত মহারাজকে। কোন দল কাকে মনোনয়ন দেবে, সেটা অবশ্যই তাদের দলীয় বিষয়। কিন্তু বিজেপি–‌র মধ্যে যোগ্য কাউকে পাওয়া গেল না যাঁকে রাজ্যসভায় পাঠানো যায়!‌ শেষে কিনা অনন্ত মহারাজ!‌ যিনি তার কদিন আগে তৃণমূলের মঞ্চে ছিলেন। যিনি বছরের অধিকাংশ সময় ফেরার থাকেন!‌ যিনি কোন দলের সমর্থক, নিজেই জানেন না। আজ বিজেপি, তো কাল তৃণমূল হতে একদিন সময় লাগবে না। এইসব আয়ারাম–‌গয়ারামদের যারা নির্বাচন করেন, তাদেরও কেমন যেন দেউলিয়া মনে হয়।

রাজনীতি থেকে লেখাপড়া, সৌজন্যবোধ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। যাঁরা এখনও সেই চর্চা বজায় রেখেছেন, যাঁরা এখনও বাগ্মীতার জন্যই স্মরণীয়, শমীকবাবু তাঁদের একজন। তাঁর বক্তৃতায় লোকখেপানো নেই, মিথ্যে তথ্যের বেসাতি নেই, নোঙরা আক্রমণ নেই। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে মন থেকে সবসময় একমত হতে পারি না, কিন্তু মন থেকে তাঁর পড়াশোনা ও বাগ্মিতাকে কুর্নিশ করতে দ্বিধা হয়নি। এই লোকটা কাল দল বদলে ফেলতে পারেন, কখনও এমনটা মনে হয়নি।

যাক, দেরিতে হলেও বিজেপি নেতৃত্বের সুমতি ফিরেছে। হ্যাঁ, রাজ্যসভা শমীকবাবুদেরই জায়গা। ওই সকাল–‌বিকেল পাল্টি খাওয়া অনন্ত মহারাজদের নয়।

‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.