সুরঞ্জন পাত্র
কদিন ধরেই টিভি চ্যানেলগুলো মেতে আছে মন্দির নিয়ে। যেন দেশে আর কোনও সমস্যাই নেই। যেন একটা মন্দিরই দেশের উন্নতির সোপান। যেন এই মন্দিরটা হয়ে গেলেই সারা বিশ্ব ভারতের নামে ধন্য ধন্য রব তুলবে।
অদ্ভুত এক বাতাবরণ। গোটা দেশকে মন্দির আবেগে ভাসানোর চেষ্টা। গোটা দেশকে মন্দির গেলানোর চেষ্টা। আমি বাপু নাস্তিক মানুষ। এতসব ধর্মকর্ম বুঝি না। ধর্মকে নিয়ে যদি কেউ বাণিজ্য করে, তখন তা থেকে আরও দূরে পালাই। এটুকু বুঝি, এই লোকটি ধার্মিকও নয়।
একদিকে, দেশজুড়ে অযোধ্যার প্লাবন। আর অন্যদিকে, আরও একজন। তিনি আবার সম্প্রীতি মিছিল ডেকে বসে আছেন। ওই দিনই তাঁকে পাল্টা কিছু একটা করতে হবে। পাল্টা একটা তাস খেলতে হবে। ভাবতে অবাক লাগে, বিরোধী দলগুলি কী কর্মসূচি নেবে, সেটাও শাসক দল ঠিক করে দিচ্ছে। সবাইকেই কোনও না কোনও মন্দিরে ছুটতে হচ্ছে। বোঝাতে হচ্ছে, তাঁরাও রামকে শ্রদ্ধা করেন। একজন ফাঁদ পাতল। অন্যরা কী সুন্দর সেই পাতা ফাঁদে পা দিল।
অনেক হল ধর্মচর্চা। আমার তাহলে করণীয় কী? ঠিক করে নিলাম, আজ টিভি দেখব না। কাগজে এই সংক্রান্ত কোনও খবরও পড়ব না। যাঁরা এতে মেতে আছে, মেতে থাকুক। আমি ঠিক করলাম, বইমেলায় যাব। আমি থাকি মফস্বলে। এখান থেকে শিয়ালদা প্রায় একঘণ্টার পথ। যাওয়ার সময় তেমন সমস্যা নেই। কিন্তু ফেরার সময় বিস্তর ভিড়। তাছাড়া, বয়সটাও তো বাড়ছে। তবু ঠিক করে নিলাম, বইমেলাই যাব। সঙ্গে নিলাম দশ বছরের নাতিকে। শুধু নিজে টিভির ওই অযোধ্যা–প্লাবন থেকে দূরে থাকলেই হবে না। মনে হল, ছোট্ট নাতিটাকেও এর থেকে দূরে রাখা দরকার।
দাদু–নাতি দুই ভাই মিলে চলে গেলাম মেলায়। আহ, যেন তাজা এক অক্সিজেন। আমার নাতিটি একটু ভোজনরসিক। বইয়ের থেকে খাবারের প্রতি একটু বেশি ঝোঁক থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাই শুরুতেই মনে হল, ওর পেটটা আগে ঠান্ডা করা দরকার। নিয়ে গেলাম ফুড স্টলে। ওর পছন্দমতো জিনিস কেনা হল। আমিও সঙ্গ দিলাম।
ব্যাস, এবার তাহলে যাওয়া যাক বইয়ের সমুদ্রে। নিয়ে গেলাম দেব সাহিত্য কূটীরে। চাইছিলাম, ও কোনও একটা বই পছন্দ করুক। দেখলাম, এটা–সেটা নেড়েচেড়ে দেখছে। শেষমেশ লীলা মজুমদার আর অন্নদাশঙ্কর রায়ের বই পছন্দ হল। অন্য একটা স্টলে গিয়ে ভ্রমণের ওপর একটা বই কিনতে চাইল। আরও একটা স্টলে গিয়ে খেলার দুটো বই। ফাঁকে ফাঁকে আমিও টুকটাক কিছু কিনে ফেললাম। আমার প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণ। তাঁর প্রায় সব বই–ই পড়া। তবু বইমেলায় নতুন নতুন আঙ্গিকে বিভিন্ন প্রকাশক বিভূতিভূষণকে হাজির করেন। সেগুলো কিনব না! নতুন বই না হয় আরও একবার পড়ব! তাছাড়া, আমি অনেককেই বই উপহার দিই। কাউকে না হয় উপহার হিসেবেই দেওয়া যাবে।
সেলিব্রিটি দর্শনও কম হল না। আমি আবার সবাইকে ঠিকঠাক চিনি না। নাতি দেখলাম, অনেককেই চিনতে পারল। কয়েকজনের কাছে গিয়ে সেলফিও তুলল। সে তুলুক। ওর কাছে এই স্মৃতিটা থেকে যাবে। তাছাড়া, ঘরে থাকলে কীই বা করত! সেই তো ফেসবুকে মোদি বন্দনা দেখত। সেই তো অযোধ্যায় সেলিব্রিটিদের হাজিরা আর জোড়হাত করে দাঁড়িয়ে থাকা দেখত। তার থেকে বইমেলার এই ভীড়, এই বইয়ের সমুদ্র দেখা অনেক ভাল।
না, আমরা দাদু–নাতি মিলে পাল্টা কোনও মিছিলে যাইনি। কোনও মন্দিরে গিয়ে নিজেদের রামভক্ত প্রমাণ করার চেষ্টাও করেনি। আমরা গিয়েছিলাম বইমেলায়। হ্যাঁ, এটাই আমাদের প্রতিবাদ।