সিকিম আজি খুলিয়াছে দ্বার

অরিত্র দাস

একবার ট্রেন থেকে এনজেপি–‌তে নামলেই হল। আপনার কান ঝালাপালা হয়ে যাবে। গ্যাংটক–‌গ্যাংটক। আবার কেউ চিৎকার করবেন দার্জিলিং–‌দার্জিলিং। যেন, এই দুটো ছাড়া আর যাওয়ার জায়গাই নেই। সিকিম মানেই যেন গ্যাংটক।

অথচ, আমার কিন্তু গ্যাংটক একেবারেই ভাল লাগে না। ছোটবেলায় অনেকের মুখেই গ্যাংটকের কথা শুনতাম। মনে হত, একবার না একবার ঠিক যাব। তখনও সোশ্যাল মিডিয়া নামক শব্দটা আমাদের জীবনের ডিকশেনারিতে ঢুকে পড়েনি। তখন ভ্রমণ মানে, কিছু বেড়ানোর ম্যাগাজিন। আর লোকের মুখে শোনার অভিজ্ঞতা।

সিকিমের প্রথমে গিয়েছিলাম গ্যাংটকেই। সেবার গ্যাংটকেই তিনদিন থেকে ফিরে এসেছিলাম। বয়স কম ছিল। ভালই লেগেছিল। কিন্তু পরে সিকিমের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হল। প্রায় প্রতি বছরই কোনও না কোনও জায়গায় চলে যেতাম। কোনওবার নামচি, কোনওবার রাবাংলা, কোনওবার পেলিং, কোনওবার রিনচেম্পং। আবার কখনও বরফের হাতছানিতে ছাঙ্গু, নাথুলার দিকেও গিয়েছি। যত দিন গেছে, সিকিমকে যেন নতুন করে চিনেছি। তখন সিকিম মানে আমার কাছে আর শুধু গ্যাংটক নয়। সিকিম মানে শুধু ছাঙ্গু–‌নাথুলা নয়।

মাঝে মাঝেই ধস নামে। পর্যটকরা আটকে পড়েন। তখন খুবই খারাপ লাগে। মনে প্রাণে চাই, ধস সরিয়ে আবার যেন সবাই ঠিকঠাক বাড়ি ফিরে আসেন। বছর দশেক আগে, আমিও একবার আটকে পড়েছিলাম। আমরা তিন বন্ধু সেবার গিয়েছিলাম। সরু রাস্তা। হাজার হাজার গাড়ির লাইন। কোথায় শুরু, কোথায় শেষ, কিছু বোঝাই যাচ্ছিল না। গাড়ির পাশ দিয়ে যে হেঁটে যাব, সে উপায় টুকুও ছিল না। প্রায় পাঁচ–‌ছয় ঘণ্টা ওই অবস্থাতেই থাকতে হয়েছিল। ধন্যবাদ দেব সেই সেনা জওয়ানদের। যাঁরা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সেবার ওই চার–‌পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে রাস্তা বানিয়ে দিয়েছিলেন। সুন্দরভাবে ট্রাফিক সামলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছিলেন। সেনাবাহিনী যে কত নিঃশব্দে কাজ করে, আমরা জানতেও পারি না। তখনই বুঝলাম, সেনাবাহিনী শুধু যুদ্ধ করে না। নীরবে তাঁরা এসব কাজও করে।

এবারও ঠিক পুজোর আগে, একইরকম বিপর্যয়। আমারও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ছুটি না পাওয়ায় যাওয়া হয়নি। আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন আটকে পড়েছিল। নিয়মিত তাদের ফোন করে গেছি। সাহস দেওয়ার চেষ্টা করেছি। বারবার বুঝিয়েছি, ভয়ের কিছু নেই। সেনা জওয়ানরা আছেন। ওঁদের ওপর ভরসা রাখো। ওরা ঠিক তোমাকে বাড়ি পাঠাবেন।

এবার এতটাই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, সিকিম সরকার বাধ্য হয়েই বলেছিল, ‘‌দয়া করে এখন কেউ বেড়াতে আসবেন না।’‌ কিছুটা কষ্টই পেয়েছিলাম। আমার প্রিয় সিকিমে আর যেতে পারব না!‌ নিজেকে বুঝিয়ে ছিলাম, আমাদের বেড়ানোটাই শেষ কথা নয়। যে বিপর্যয় হয়েছে, ওদেরও ঘুরে দাঁড়ানোর সময় দিতে হবে। আমরা যদি গিয়ে উৎপাত করি, তাহলে রাস্তা সারাই হবে কী করে?‌ নদীর ওপর ওই সব সেতু মেরামত হবে কী করে?‌ তাই এই সময়টায় আমাদের একটু দূরে থাকাই ভাল।

ভাবতে ভাল লাগছে, সিকিম আবার তার দরজা খুলে দিয়েছে। আবার প্রাণের ডাক দিয়েছে। হ্যাঁ, আবার আমরা যাব। এনজেপি–‌র সেই গাড়িওলা যতই গ্যাংটক–‌গ্যাংটক করে চিৎকার করুক, আমরা ছুটে যাবে সেই শান্ত, স্নিগ্ধ পাহাড়ি গ্রামে। আমার কাছে ওটাই আসল সিকিম।
‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.