শর্মিষ্ঠা কুণ্ডু
গত কয়েকবছরে একটা অদ্ভুত ট্রেন্ড শুরু হয়েছে। শহরের নানা প্রান্তে বিশাল হোর্ডিং। সিনেমার নয়, সিরিয়ালেরও নয়। আসলে, ওয়েব সিরিজ। সিনেমা হল, টিভির বাইরেও খুলে গেছে অন্য একটা দিগন্ত। অর্থাৎ, হলে যাওয়ার দরকার নেই। টিভির সামনে বসারও দরকার নেই। মোবাইলেই মগ্ন থাকুন। সেখানেই যা দেখার, দেখে নিন।
একের পর এক ওটিটি চ্যানেল হাজির হয়ে গেছে। নিত্যনতুন কনটেন্ট নিয়ে তারা হাজির। বিনোদন জগতের নতুন দরজা যেন খুলে গেছে। কত নতুন নতুন কনটেন্ট নিয়ে ছবি হচ্ছে। প্রথমত, এখানে বাজেট অনেকটাই কম। ফলে, এমন অনেক কনটেন্ট শুনে প্রোডিউসার পালিয়ে যান। কিন্তু এখানে অল্প বাজেট। ফলে সেইসব পরীক্ষা–নিরীক্ষা অনায়াসে করা যায়। বড়সড় তারকা নিতে পারলে ভাল। না নিলেও ক্ষতি নেই। একটা পরিচিত মুখ থাকলেই হল। তিনি টেনে নিয়ে যাবেন। বাকি দু’একজন অল্প পরিচিত। বাকিরা আনকোরা হলেও চলে যায়।
কিন্তু অল্প টাকায় ছবি হলে তার কিছু ভাল দিক যেমন থাকে, তেমনই কিছু বেনোজলও ঢুকে পড়ে। যে পারছেন, পরিচালক হয়ে যাচ্ছেন। রিসার্চের নামে যা খুশি গেলানো হচ্ছে। শহরজুড়ে হোর্ডিং, তার ওপর সোশ্যাল মিডিয়ায় লাগাতার ক্যাম্পেনিং তো আছেই। লোকে ভাবছেন, দারুণ কিছু কনটেন্ট। কিন্তু একটা বা দুটো পর্ব দেখার পরই মোহভঙ্গ হতে সময় লাগছে না।
আবার কোনও কোনও ওয়েব সিরিজ যেন সিরিয়ালেরই একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ। মেগা সিরিয়াল যেমন বছরের পর বছর চলে, এটাও তেমনি দশ এপিসোড, বারো এপিসোডে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সিরিয়াল যদি নেশা ধরাতে পারে, তাহলে ওয়েব সিরিজই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? এখানেও ঢুকে পড়ছে পরকীয়া। ঢুকে পড়ছে মেলোড্রামা। ঢুকে পড়ছে পারিবারিক কূটকচালি। সাসপেন্সের নামে অকাতরে ঢুকে পড়ছে ভায়োলেন্স। আর যৌনতার সুড়সুড়ি তো আছেই।
সবকিছুরই নিজস্ব খদ্দের আছে। কেউ খুনখারাপি দেখতেই ভালবাসেন। কেউ ভালবাসেন সারাক্ষণ ঝগড়া দেখতে। কূটকচালি তো দারুণ উপাদেয়। সিরিয়ালে দেখে নিজের সংসারে সেগুলো প্রয়োগ করা। মফস্বলের কত পরিবারে নিত্য অশান্তি সেইসব কূটকচালির প্রয়োগকে ঘিরে। এসব নিয়ে আর্থসামাজিক সমীক্ষা হওয়াটা খুব জরুরি। শুধু কিছু সিরিয়াল জনজীবনকে কতখানি বিষিয়ে দিয়েছে, তার কোনও হিসেব নেই। সেই প্রবণতা এবার কি ওয়েব সিরিজের হাত ধরেও চলে আসছে!
ইদানীং নতুন একটা প্রবণতা শুরু হয়েছে, সেশন ওয়ান, সেশন টু। মানে, সেশন ওয়ানে আট–দশ পর্ব। এমন জায়গায় শেষ করা হচ্ছে, যা ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’। ‘অন্তরে অতৃপ্তি’ থেকেই যাচ্ছে। সেই অতৃপ্তি থেকেই হাজির হয়ে যাচ্ছে সেশন টু। অর্থাৎ, আরও আট–দশ পর্ব। আসলে, যেন মেগা সিরিয়ালেরই কন্টিনিউয়েশন।
ভাল কনটেন্ট অবশ্যই স্বাগত। নতুন প্রযুক্তি থেকেও মুখ ফিরিয়ে থাকার উপায় নেই। কিন্তু সেই প্রযুক্তির হাত ধরে, নতুন ধারার হাত ধরে আবার যদি সেই বিষবাষ্প ঢুকে পড়ে, তা বেশ উদ্বেগের। ওয়েব সিরিজের শুরুর দিনগুলোয় কিছুটা স্বস্তি পাওয়া গিয়েছিল, যাক, সিরিয়ালের কূটকচালি থেকে কিছুটা অন্তত মুক্তি পাওয়া গেল। কিন্তু গত কয়েক বছরে আস্তে আস্তে ওয়েব সিরিজেরও সিরিয়ালীকরণ হয়ে গেল। ভাল ছবিকে যেমন আর্ট ফিল্ম বলে দাগিয়ে দেওয়া হত, এখানেও ভাল কনটেন্ট আবার সেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে না তো!