বিধানসভা কোন অর্বাচীনদের হাতে, ফের বেআব্রু হয়ে গেল

স্বরূপ গোস্বামী

আইনসভা কাদের জন্য?‌ যাঁরা আইন নির্মাণ করবেন, তাঁদের জন্য। অর্থাৎ, যাঁরা আইন নির্মাণ করবেন, তাঁদের নিজেদের অন্তত আইন সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। মোদ্দা কথা, পেটে একটু বিদ্যেবুদ্ধি থাকা জরুরি।

কিন্তু স্রোতের অনুকূলে মল, মূত্র, আবর্জনা সব ভেসে যায়। তেমনই হয়েছে আইনসভার দশা। কী লোকসভা, কী বিধানসভা— এমন এমন লোকেরা নির্বাচিত হয়ে আসছেন, যাঁদের ওই চত্বরে পা রাখারই যোগ্যতা নেই। আইন বোঝেন, ন্যূনতম লেখাপড়াটুকু আছে, সংসদীয় শিষ্টাচার মানেন, এমন সদস্যরা নিতান্তই সংখ্যালঘু। হল্লাবাজ আর আকাট মূর্খদের হাতেই চলে যাচ্ছে সংসদ ও বিধানসভা।

তেমনই হয়েছেন স্পিকার। ওই চেয়ারের কী মর্যাদা, আজও তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না। একের পর এক দপ্তরের বাজেট গিলোটিনে চলে যায়। আলোচনা ছাড়াই পাস হয়ে যায়। এটা কতটা লজ্জার, এই বোধটুকুও তাঁর তৈরি হয় না। তিন দফা মিলিয়ে অন্তত পঞ্চাশজন বিরোধী বিধায়ক দলবদলে শাসক দলের পতাকা নিয়েছেন। একটি ক্ষেত্রেও তিনি কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেননি। ভারতবর্ষের আর কোনও স্পিকার নিজের চেয়ারকে এতখানি কলঙ্কিত করেননি।

এবার নতুন সংযোজন। কয়েকজন বিজেপি বিধায়ক নাকি বিধানসভা চত্বরে জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননা করেছেন। হেয়ার স্ট্রিট থানায় এই মর্মে এফআইআর হয়ে গেল। প্রথমত, আম্বেদকার মূর্তির সামনে তৃণমূল বিধায়কদের একটি ধর্না চলছিল। একেবারেই দলীয় কর্মসূচি। এটা আর যাই হোক, সরকারি কর্মসূচি নয়। সেখানে কেউ যদি জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে থাকেন, তার সঙ্গে সবাইকে নীরবতা পালন করতে হবে, এমনটা কোথায় লেখা আছে!‌ ধরা যাক, রাস্তায় এক পাগল জাতীয় সঙ্গীত গাইতে শুরু করল। তার মানে কি রাস্তায় সব যানবাহন থামিয়ে দিতে হবে?‌

ধরেই নিলাম, বিজেপির বিধায়করা জাতীয় সঙ্গীতের সময় চিৎকার করেছেন। এতে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়েছে। তাই বলে সরাসরি থানায় এফআইআর!‌ তাই বলে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে লালবাজারে তলব!‌ বিধানসভা চত্বরে কোনও অনিয়ম হলে অভিযোগ জানানোর কথা স্পিকারের কাছে। তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেই পারেন। তিনি মনে করলে তদন্তের পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই পারতেন। কিন্তু তাঁর কাছে না গিয়ে পরিষদীয় মন্ত্রী থানায় এফআইআর করে বসলেন।

শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় একজন বর্ষীয়াণ মন্ত্রী। হাতে গোনা যে কয়েকজন আইনকানুন জানেন, সংসদীয় রীতিনীতি বোঝেন, তাঁদের একজন। দশচক্রে তাঁরও কিনা এমন অবস্থা?‌ বিধানসভার স্পিকারকে অভিযোগ না জানিয়ে তিনি কিনা থানায় এফআইআর করে বসলেন!‌ এতে কার সম্মানহানি হল?‌ এটা কি কার্যত স্পিকারের চেয়ারকেই উপেক্ষা করা হল না?‌

সেই এফআইআর–‌এও কত বিভ্রাট!‌ দশজনের নামে এফআইআর। তার মধ্যে চারটি নামে গণ্ডগোল!‌ প্রথমত, আলিপুরদুয়ারের বিধায়ক সুমন কাঞ্জিলাল। জিতেছিলেন বিজেপির হয়ে। এখন সেই ‘‌দলবদলু’‌ বিধায়ক তৃণমূলে। সেদিন তিনি কালো পোশাক পরে ছিলেন তৃণমূলের ধর্নায়। অথচ, তাঁর নামেই কিনা এফআইআর হয়ে গেল। অন্যের মুখের ঝাল খেতে গেলে এমনটাই হয়।

আরও তিনজন এমন বিধায়কের নাম দেওয়া হল, যাঁরা সেদিন বিধানসভা চত্বরেই ছিলেন না। বিধানসভার এত এত সিসিটিভি রয়েছে। গেট দিয়ে ঢুকলেই তো ছবি উঠে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেই গরহাজির থাকা তিন বিধায়কের নামেও এফআইআর হয়ে গেল!‌ তাঁরা কি বাড়ি থেকে জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননা করলেন!‌

তাহলে, মোদ্দা কথাটা কী দাঁড়াল?‌ ১) বিধানসভার অভ্যন্তরের ঘটনা। অথচ,‌ স্পিকারকে পাত্তা না দিয়ে থানায় এফআইআর করা হল। ২)‌ যে দশজনের নামে অভিযোগ, তার চারটি নাম একেবারেই ভুয়ো। অর্থাৎ, মিথ্যে তথ্য দিয়ে এফআইআর করা। ভাবতে অবাক লাগে, একজন বর্ষীয়াণ পরিষদীয় মন্ত্রীকে এমন মিথ্যাচারের আশ্রয় নিতে হল!‌

যখন বুঝলেন, গণ্ডগোল হয়ে গেছে, তখন স্পিকারের কাছে নালিশ হল। অর্থাৎ, আগে থানায় যাওয়া, তারপর স্পিকারের কাছে যাওয়া। নিয়ম অনুযায়ী, স্পিকার অনুমতি দিলে তবেই বিধানসভার অভ্যন্তরের ঘটনা নিয়ে পুলিশ তদন্ত করতে পারে। কিন্তু স্পিকারকে না জানিয়েই হয়ে গেল থানায় নালিশ।

এই ছোট্ট ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, কেমন চলছে বিধানসভা। কেমন চলছে প্রশাসন। এঁরা চালাবেন রাজ্য?‌ একটা পঞ্চায়েত চালাতে গেলে যে ন্যূনতম বিদ্যেটুকু লাগে, সেটুকুও এঁদের নেই। নিজেরাই রোজ নিজেদের বিবস্ত্র করে চলেছেন। বিধানসভার পদাধিকারী হয়ে যাঁরা রোজ বিধানসভাকে এভাবে কলঙ্কিত করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অবমাননার মামলা হয় না!‌

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.