‌এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যানের সাংসদ পদ আগে খারিজ হোক

রক্তিম মিত্র

গত কয়েকদিন ধরেই শিরোনামে আসছে এথিক্স কমিটি। এই কমিটি একেবারে উঠেপড়ে লেগেছে, যেভাবেই হোক ‘‌দেশদ্রোহী’‌দের সাজা দিতেই হবে। সংসদ থেকে তাঁদের বহিষ্কার করতেই হবে।

নারদা তদন্তের সময় এই এথিক্স কমিটির কথা উঠে আসত। অশ্বডিম্ব প্রসব বলতে যা বোঝায়, ঠিক সেটাই করেছিল এই এথিক্স কমিটি। ৯ বছর পেরিয়ে গেল। এখনও একটি মিটিংও করে উঠতে পারেনি এই এথিক্স কমিটি। নির্বাচিত সাংসদরা হাত পেতে টাকা নিচ্ছেন, এমন অকাট্য প্রমাণ থাকার পরেও গড়িমসি করে নটা বছর কাটিয়ে দিল।

এখন তাঁদের যত তৎপরতা, মহুয়া মৈত্রকে নিয়ে। যেভাবেই হোক, তাঁর সাংসদ পদ খারিজ করতেই হবে। তড়িঘড়ি অভিযোগ জমা পড়ে গেল। সাতদিনে তিনবার মিটিং বসে গেল। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মহুয়াকে ডেকে পাঠানো হল। এত এত দপ্তরকে কাজে লাগানো হল। সেই পর্বতের মুষিক প্রসব। যে বিষয় নিয়ে তদন্ত হওয়ার কথা, সেই বিষয়ে তদন্তে কিছুই পাওয়া গেল না। তারপরেও মহুয়াকে বহিষ্কারের সুপারিশ করে বসল এই কমিটি। একা মহুয়াকে এত ভয়!‌ তাঁর পেছনে এমনভাবে রাষ্ট্রশক্তিকে লেলিয়ে দিতে হচ্ছে!‌

মহুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি নাকি অর্থ ও উপহারের বিনিময়ে সংসদে প্রশ্ন করেছেন। ডেকে পাঠাতেও হল না। চিঠি দিয়ে বক্তব্য জানতেও চাওয়া হল না। দুবাই থেকে জনৈক ব্যবসায়ী নিজের বক্তব্য পাঠিয়ে দিলেন। উৎকোচ তত্ত্ব দাঁড়াল না। এবার এথিক্স কমিটি পড়ল লগ ইন আইডি ও পাসওয়ার্ড নিয়ে। মহুয়া লগ ইন আইডি কেন অন্য কারও সঙ্গে শেয়ার করেছেন, কেন বিদেশ থেকে লগ ইন করা হয়েছিল, এটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়াল। এতে নাকি দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়েছে।

সত্যিই, ভাবতে অবাক লাগে, এই সংসদ নিজেকে কতখানি হাসির খোরাক করে তুলতে পারে। লোকসভা বা বিধানসভার স্ট্যান্ডিং কমিটির আলোচনা বাইরে আসে না। সেটাই প্রথা। সেখানে গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু এখানে এথিক্স কমিটিতে কী আলোচনা হচ্ছে, বাইরের লোকেরা মুহূর্তে জেনে যাচ্ছেন। তাঁরা আবার ঘটা করে প্রেস কনফারেন্স করছেন। এমনকী এথিক্স কমিটি লোকসভার স্পিকারের কাছে কী সুপারিশ করছে, তা আগাম পেটোয়া মিডিয়ার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। তারা সেই চিঠি দেখিয়ে টিআরপি বাড়াতে চাইছে। এখান থেকেই বোঝা যায়, এই এথিক্স কমিটি কতখানি দায়িত্বশীল।

বিদেশ থেকে অন্য কেউ লগ ইন করলে দেশের সুরক্ষা বিপন্ন হয়ে পড়ে। আর এথিক্স কমিটির সুপারিশ স্পিকারের কাছে পৌঁছনোর আগে মিডিয়ার কাছে পৌঁছে যায়, এতে সুরক্ষা বিপন্ন হয় না!‌ আদানির মালিকানাধীন চ্যানেল কীভাবে সেই গোপন রিপোর্ট পেল, কেনই বা ফলাও করে প্রচার করল, তার তদন্ত কে করবে?‌

আসলে, মৌচাকে ঢিল মেরেছেন মহুয়া। নতুন সাংসদ। কিন্তু সংসদে একের পর এক ভাষণে বুঝিয়ে দিয়েছেন, একজন সক্রিয় সাংসদ সরকাররে কতখানি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারেন। তিনি যখন বলতে ওঠেন, পুরো ট্রেজারি বেঞ্চকে সত্যিই বড় অসহায় মনে হয়। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি করুণা হয়। ওঁরা নিজেরাও বোঝেন, এই মেয়ের সঙ্গে যু্ক্তির দৌড়ে পেরে ওঠা যাবে না। এই মেয়ে ভরা সংসদে সরকারকে বেআব্রু করে দেয়। অতএব, এর চরিত্রহনন করো। এর গায়ে দেশদ্রোহীর তকমা এঁটে দাও।

এথিক্স কমিটির ঘাড়ে কটা মাথা আছে, তারা নিজে থেকে এতখানি সক্রিয় হবে?‌ নারদায় তারা যে ঘুমিয়ে ছিল, সেটাও ওপরওয়ালার নির্দেশে। এখানে তারা যে অতি সক্রিয়, সেটাও সেই ওপরওয়ালার ইচ্ছেতেই। প্রথমত, এনআইসি লগ ইন কে করতে পারবেন, কে পারবেন না, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনও নির্দেশিকা নেই। বিজেপির এত এত সাংসদ। কজন নিজেদের লগ ইন আইডি অপারেট করতে পারেন?‌ কজন নিজের প্রশ্ন নিজে করতে পারেন?‌ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর টুইটার হ্যান্ডল থেকে যে সব পোস্ট করা হয়, তা প্রধানমন্ত্রী নিজে লেখেন!‌ অতি বড় মোদিভক্তকেও বিশ্বাস করানো যাবে!‌ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ইংরাজি বিদ্যার দৌড় কতদূর, এতদিনে দেশবাসী বেশ বুঝে গেছেন। কাজেই, ওইসব টুইট হাজার চেষ্টা করলেও তিনি লিখতে পারবেন না। তাঁর হয়ে তাহলে কে লেখেন?‌

ভাবতে অবাক লাগে, কোন মূর্খের রাজত্ব চলছে!‌ প্রধানমন্ত্রী ইংরাজি বলতে পারেন না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পারেন না। স্পিকারকেও সেভাবে ইংরাজি বলতে শোনা যায় না। এমন নয় যে এঁরা হিন্দি ভাষায় দারুণ পারদর্শী। এমন নয় যে তাঁরা হিন্দিকে দারুণ ভালবাসেন। মোদ্দা কথা হল, ইংরাজি বলতে পারেন না। তাই হিন্দিতে আশ্রয় খোঁজেন। এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যানকেও সেই ভূমিকাতেই দেখা গেল। টিভিতে কয়েকটা বাইট দেখেই তাঁরও ইংরাজি ও বিদ্যেবুদ্ধির দৌড় বোঝা গেল। বোঝা গেল, মহুয়ার সামনে দাঁড়ানোর কোনও যোগ্যতাই তাঁর নেই। মহুয়ার ঝড়ের কাছে স্রেফ উড়ে যাবেন। মহুয়ার যুক্তির কাছে এই চেয়ারম্যানেরই ‘‌বস্ত্রহরণ’‌ হয়ে যাবে। এইসব লোককে রাজার পার্ট দিলে যাত্রা ভন্ডুল হবেই।

কী আলোচনা হল, বাইরে এসে বলে দিচ্ছেন। কে কী চিঠি জমা দিল, সেগুলো বাইরে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। মিডিয়ার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এমনকী এথিক্স কমিটি কী সুপারিশ করতে চলেছে, সেই লিখিত বয়ানও পৌঁছে যাচ্ছে আদানির পোষ্য মিডিয়ার কাছে। মহুয়া নয়, এই গুণধর চেয়ারম্যানের আগে বিচার হওয়া দরকার। দেশের নিরাপত্তার জন্য মহুয়া নন, চেয়ারে বসে থাকা এই অপদার্থ লোকগুলো অনেক বেশি বিপজ্জনক।

সংসদটা আর যাই হোক, এমন অকাট মূর্খদের জায়গা নয়। গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও এই কথাটা আরও স্পষ্ট করে বলার সময় এসেছে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.