আড়াল থেকেই এমন মহাকাব্য লেখা যায়

মিডিয়া সমাচার

অজয় নন্দী

কী দুরন্ত একটা ইনিংস। কী দুরন্ত একটা ম্যাচ।

আফগানিস্তানের কে কত রান করল, তার উল্লেখ নেই। অস্ট্রেলিয়ার কোন বোলার কটা উইকেট নিয়েছে, তার উল্লেখ নেই। শুরুতে অস্ট্রেলিয়ার কোন ব্যাটসম্যান কত রান করেছে, তার কিছুই নেই।
তারপরেও বলতে হবে, এবারের বিশ্বকাপের সেরা ম্যাচরিপোর্ট।

যেদিন বিরিয়ানি হয়, সেদিন সুক্তো করতে নেই। আনন্দবাজারের প্রথম পাতায় দুরন্ত এই ম্যাচরিপোর্টটা যেন এটাই আরও ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে গেল।

কিন্তু আমাদের আলু ভাজাও চাই, বিরিয়ানিও চাই, সুক্তোও চাই, মাছের মাথা দিয়ে মুগ ডালও চাই। তাই সেটা জগাখিচুড়ি হয়ে দাঁড়ায়।

ম্যাচ অন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেলে, সেই লেখাকেও অন্য একটা উচ্চতায় নিয়ে যেতে হয়, এটাই তো চ্যালেঞ্জ। ম্যাচ পৌঁছে গেল মহাকাব্যের স্তরে। অথচ, সেদিন লেখাগুলো নেমে আসে একেবারে কেরানির স্তরে।

কোনও কোনওদিন নিজেকে ছাপিয়ে গিয়ে এভাবেই ম্যাক্সওয়েল হয়ে উঠতে হয়। আনন্দবাজারের এই প্রতিবেদনটাও যেন সেই ম্যাক্সওয়েল হয়ে ওঠা। নিঃসন্দেহে, এবারের বিশ্বকাপের সেরা ম্যাচ রিপোর্টিং।

অথচ, কোনও বাইলাইন নেই। কে লিখেছেন, বোঝার উপায়ও নেই। যিনিই লিখে থাকুন, তাঁর পায়ে কুর্নিশ জানাতেই হয়। এরকম দুরন্ত ইনিংস যেমন ক্রিকেটকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়, তেমনই এমন দুরন্ত কভারেজ ক্রীড়া সাংবাদিকতাকেও দৈনন্দিন গ্লানিভরা ম্যাড়মেড়ে কভারেজ থেকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। এই এক মাসে এত এত লোকের নামে লেখা বেরোলো, কিন্তু এমন উচ্চতায় কেউ নিজেকে নিয়ে যেতে পেরেছেন?‌ ধারেকাছেও কেউ পৌঁছতে পেরেছেন?‌ ‌হয়ত স্পোর্টসের কেউ লেখেনওনি। কারণ, যাঁদের নামে প্রকাশিত লেখা পড়ি, তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না হঠাৎ করে নিজেকে এই উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া।

সে ক্রিকেটের কীই বা বোঝে, যে শুধু ক্রিকেট বোঝে!‌

বড় ইভেন্ট মানেই আমরা বুঝি ঢাউস ঢাউস ছবি। সঙ্গে স্ট্যাট। ভুলভাল উদ্ধৃতির বন্যা। মোটামুটি চেনা ছক। প্রায় সব কাগজই এমন গড্ডালিকা প্রবাহেই ভেসে যায়। আমরা লেখার সঙ্গে কোট মেশাই। কী কোট?‌ ‘‌এমন খেলতে পেরে দারুণ লাগছে। আশা করি, সামনের ম্যাচগুলিতেও এভাবেই খেলতে পারব.‌.‌.‌.‌। ইত্যাদি, ইত্যাদি।’‌ বড্ড এক ফাঁকিবাজি। আসলে, উদ্ধৃতিতে ভরে দিলে আর মাথা খাটিয়ে লিখতে হয় না। শব্দের কোটা কমপ্লিট। কোট আছে, কেউ কিছু বলবেও না।

অথচ, এখানে!‌ মাত্র দুটো লাইন। কী তাৎপর্যপূর্ণ দুটো লাইন। ঠিক নুনের মতো। ততটুকুই লাগবে, যতটুকু না দিলে নয়। কারণ, বেশি নুন দিলেই নোনতা হয়ে যাবে।

আচ্ছা, ওই লেখাকে কী বেঢপ কাট আউট মার্কা লেআউটের আশ্রয় নিতে হয়েছে?‌ তাও হয়নি। ছবি আছে, ছবির মতো। লেখা আছে লেখার মতো। একটা সঙ্গে অন্যটা মিশে গিয়ে ট্র‌্যাফিক জ্যাম তৈরি করেনি।

তাহলে কী বোঝা গেল?‌ বাইলাইন লাগে না। কে লিখছে, তাতে পাঠকের কিচ্ছু যায় আসে না। লেখাটাই থেকে যায়। লেখাটাই অমরত্ব পায়। বারবার পড়তে ইচ্ছে করে। কিন্তু প্রশ্ন হল, পড়লেন কজন!‌ এই প্রজন্মের পাঁচজন ক্রীড়া সাংবাদিক আছেন, যাঁরা এই লেখা পড়েছেন!‌ অথচ, তাঁরা ইডেনের প্রেসবক্স আলো করে বসেছেন। কুপন হাতে লাঞ্চ বা ডিনারের বুফেতে দাঁড়িয়েছেন। গলায় কার্ড ঝুলিয়ে ল্যাপটপ খুলে রেখে সোশ্যাল সাইটে ঘনঘন জাহির করেছেন, ‘‌দেখো, আমি প্রেসবক্সে বসে আছি।’‌ অথচ, এমন একটা দুরন্ত ম্যাচরিপোর্ট পড়েও দেখেননি। সময় কোথায়!‌

এই লেখা কারও নামে বেরোয়নি। তাই কেউ তার ওয়ালে শেয়ার করবে না। লাইক, কমেন্টের বন্যা বইবে না। কেউ মিনিটে মিনিটে লাইক, কমেন্ট গুনতে বসবে না। কেউ তার হোয়াটসঅ্যাপ স্টেটাসে দিয়ে জাহির করবে না। আসলে, যাঁরা আত্মপ্রচারের এই মহান কাজগুলো করেন, চোদ্দ জন্ম তপস্যা করলেও সেই ‘‌ফেবুজীবী’‌দের হাত থেকে এই মহাকাব্য বেরোবে না।

আর আড়াল থেকে যিনি লিখেছেন, তিনি কখনই এই খেলো কাজটা করবেন না। তাঁরা আড়ালে থাকতে জানেন বলেই এমন মহাকাব্য লিখতে পারেন।

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.