বরুণ বিশ্বাসরা এভাবেই বেঁচে ওঠেন

অভিরূপ কুমার

কয়েদিন আগেই শহর ছেয়ে গিয়েছিল একটা ছবির হোর্ডিংয়ে— আবার প্রলয়। ছবিটা অবশ্য হলে মুক্তি পায়নি। বানানো হয়েছিল ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য। নানা জায়গায় ছবিটা নিয়ে চর্চাও হয়েছে। মোটের ওপর, বেশ সফল ছবিই বলা যায়।

ঠিক বছর দশেক আগে, এমনই একটি ছবিকে নিয়ে হইচই হয়েছিল। সেটির নাম ছিল প্রলয়। এবারের ‘‌আবার প্রলয়’‌ আসলে তারই সিকুয়েল। দশবছর আগের সেই ছবি ছিল প্রতিবাদী বরুণ বিশ্বাসকে সামনে রেখে। পরিচালক রাজ চক্রবর্তী। বরুণের ভূমিকায় পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, তাঁর প্রেয়সীর ভূমিকায় মিমি চক্রবর্তী।

না, তখনও তাঁরা কেউ প্রকাশ্য তৃণমূল ছিলেন না। রাজ তখনও বিধায়ক হননি। মিমিও তখন সাংসদ হননি। আর পরমব্রত তখনও দেউচা–‌পাচামিতে জড়িয়ে পড়েননি। তাই তাঁরা যে কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে ছবি করছেন, কারও তেমনটা মনেও হয়নি।

কী দেখানো হয়েছিল?‌ বরুণ বিশ্বাস একজন শিক্ষক। এলাকায় প্রতিবাদী মুখ। ধর্ষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছেন। এলাকার নানা অসামাজিক কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। ফলে, স্থানীয় সমাজবিরোধীদের হাতে তাঁকে খুন হতে হল।

কিন্তু এমনভাবে ছবিটি তৈরি হয়েছিল, মনে হবে, যেন স্থানীয় সিপিএমই বরুণকে খুন করেছে। বরুণ বোধ হয় সিপিএম নেতাদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছিল। লাল পতাকা থেকে শুরু করে নানা সংলাপে সেটাই যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ঘটনা হয়েছিল, বরুণ খুন হয়েছিলেন ২০১২–‌র জুলাইয়ে। তার অন্তত একবছর আগে রাজ্যে তৃণমূল সরকার এসে গেছে।

বরুণের পরিবারের দাবি ছিল, এই খুনের পেছনে এলাকার প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর হাত রয়েছে। তাঁর নির্দেশেই সরানো হয়েছে বরুণকে। কিন্তু সেসব অভিযোগকে পুলিশ কোনও আমল দেয়নি। মিডিয়াও বিশেষ লাফালাফি করেনি। ২০১১ তে ক্ষমতার পালাবদল হলেও ২০০৯ থেকেই ওই এলাকায় তৃণমূলের দাপট শুরু হয়েছে। অর্থাৎ, তখন থেকেই সিপিএম এলাকায় দাদাগিরি করার মতো জায়গায় ছিল না। অথচ, তা সত্ত্বেও সিনেমায় কীভাবে বরুণ হত্যার সঙ্গে সিপিএম–‌কে জুড়ে দেওয়া হল!‌

তারপর ইছামতী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেল। সেই মিমি সাংসদ হলেন। সেই রাজ ফিল্ম ফেস্টিভালের চেয়ারম্যান হলেন, বিধায়ক হলেন। সেই পরমব্রত সেমি ইন্টালেকচুয়াল হয়ে তৃণমূলের মঞ্চে পৌঁছে গেলেন। সেই দোর্দন্ডপ্রতাপশালী মন্ত্রীও জেলে গেলেন। স্বভাবতই ফের জীবন্ত হয়ে উঠলেন বরুণ বিশ্বাস। বরুণের পরিবার সেই সুঁটিয়া গ্রামে আর থাকতেই পারলেন না। প্রাণ বাঁচাতে তাঁদের পালিয়ে যেতে হল। এতদিনের চাপা দেওয়া কণ্ঠস্বর যেন আবার বেরিয়ে আসছে। তাঁরা আবার নিজেদের যন্ত্রণা তুলে ধরতে শুরু করেছেন।

এবার রাজবাবুর গোঁসা হল। মন্ত্রীর গ্রেপ্তারের সঙ্গে কেন তাঁদের পুরনো ছবিকে টেনে আনা হচ্ছে!‌ কেন হবে না বলুন তো!‌ তাঁরা তো ছবিতে বরুণ বিশ্বাসের নাম আর আবেগটাই ব্যবহার করেছিলেন। বরুণ হত্যার প্রতিবাদে ছবি বানাবো, আর যারা আসল অভিযুক্ত, তাদের আঁচলে আশ্রয় নেব, এই দ্বিচারিতা কেন?‌ যাঁরা সেই খুনের সঙ্গে কোনওভাবেই জড়িত নয়, তাদের জড়িয়ে দেওয়াটাই বা কোন শিষ্টাচার!‌ সেদিন হয়ত সেভাবে প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু আজ উঠবেই। এটাই সময়ের দাবি।

রাজবাবুরা বরং নিজের পুরনো ছবিটা আরও একবার দেখুন। তারপর একবার আয়নার সামনে দাঁড়ান।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.