বেঙ্গল টাইমস প্রতিবেদন
কারা বিধানসভায় এলেন, কারা এলেন না, সেই তালিকা নাকি এবার যাবে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। এরকম একটা খবর কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। এবং এটা কোনও ভেতরের খবর নয়, কোনও অজানা সূত্রের দাবি নয়। স্বয়ং পরিষদীয় মন্ত্রী বিবৃতি দিয়েই এমনটা জানিয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হল, এই তালিকা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠাতে হচ্ছে কেন? আসলে, অধিবেশন চললে বিধানসভায় আসা জরুরি। অধিবেশন চলার সময়টুকু অন্তত সভায় থাকা জরুরি, এই সহবৎ শিক্ষাটুকু আর আনা গেল না। মুখ্য সচেতক বা স্পিকার মশাই বারবার বলেছেন। কেউ পাত্তাই দেননি। বিধায়করা ভেবেই নিয়েছেন, এঁদের কথায় গুরুত্ব দিয়ে কাজ নেই। টিকিট দেওয়া বা না দেওয়া, কোনও ক্ষমতাই এঁদের নেই। খামোখা এঁদের কথা শুনতে যাব কেন? তাই এখন মুখ্যমন্ত্রীর জুজু দেখাতে হচ্ছে। তাই কিছুটা হুমকির সুরেই বলা হবে, ‘এবার কিন্তু তালিকা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাবে। তিনি নিজে সবটা দেখবেন।’ এসব শুনে যদি সম্বিত ফেরে।
আসলে, বিধানসভার গুরুত্ব সবার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। গুরুত্ব বোঝাবেন, এমন লোকও কমে আসছে। এমন এমন লোকেদের টিকিট দেওয়া হয়, এমন এমন লোকেরা নির্বাচিত হয়ে আসেন, যাঁদের বিধানসভা সম্পর্কে সমীহ থাকার কথাও নয়। লাইব্রেরিতে যাওয়া বা পুরনো প্রসিডিংস একটু পড়া, অতীতে কোন বিলের ওপর কোন বিধায়ক কীভাবে বক্তৃতা করতেন, এগুলো একটু জানা। এসব কালচার সেই কবেই হারিয়ে গেছে। এত পড়ার সময় আছে? এত পড়ার ধৈর্য আছে!
বিধানসভা মানেই হয়ে দাঁড়িয়েছে হই হট্টগোলের জায়গা। আগেও যে হট্টগোল বা হল্লাবাজি হত না, এমন নয়। কিন্তু হল্লাবাজের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। এখন সময় বদলেছে। হল্লাবাজরাই পাল্লায় ভারী। দারুণ পড়াশোনা করে এসে দারুণ বক্তৃতা দেবেন, কোনও বিলের চুলচেরা বিশ্লেষণ করবেন, তেমন বিধায়ক কজন আছেন! হাতে গোনা কয়েকজন। বিতর্কের মান পড়ে গেছে বললে কম বলা হবে। বলা যায়, মাটিতে মিশে গেছে। অন্যের কথা শোনার ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, শিষ্টাচার—সবই যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
বিরোধীরা হইচই করবে, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু শাসকপক্ষ যখন হইচইয়ের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে, তখন বুঝতে হয় সঙ্কট অনেক গভীরে। অধিকাংশ দপ্তরের বাজেট চলে যায় গিলোটিনে। প্রশ্নোত্তর পর্ব নাম কে ওয়াস্তে। বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নের বড়ই অভাব। অধিকাংশ মন্ত্রী জানেনই না কীভাবে বাজেটের জবাবী বক্তৃতা করতে হয়। মন্ত্রীরাও সমানে হল্লাবাজি করে চলেছেন।
আগে বিধায়করা উল্লেখ পর্বে বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরতেন। মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হত। এখন ওই উল্লেখ পর্বটা যেন চলে গেছে জেলার প্রশাসনিক মিটিংয়ে। পাড়ার রাস্তা খারাপ, সেটা বলা হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীকে। যেটা পঞ্চায়েতের বা পঞ্চায়েত সমিতির করার কথা, সেটা হুকুম দিতে হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীকে। যে বিষয়টা বিধানসভায় ওঠার কথা, মিনমিন করে সেটা উঠছে ওই লোকদেখানো প্রশাসনিক মিটিংয়ে। ফলে, বিধানসভার গুরুত্ব সেখানেই অর্ধেকটা কমে গেছে। বিধায়করাও জানেন, মন্ত্রীকে বলে আদতে কিছুই হবে না। মন্ত্রীর কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাই নেই।
তাই বিধানসভা যে নিজের গুরুত্ব হারিয়েছে, এর পেছনে শুধু বিধায়করা নয়, অনেক পদাধিকারীরাও দায়ী। মুখ্যমন্ত্রীর জুজু দেখিয়ে হাজিরা হয়ত বাড়ানো যাবে। মান বাড়ানো বড়ই কঠিন।