এই কুণাল সত্যিই অচেনা ছিলেন

সজল মুখার্জি

কুণাল ঘোষের ওপর আমার খুব রাগ হত। সত্যিই খুব রাগ হত। একটা মানুষ কয়েকবছর আগেও চিৎকার করে বলতেন, মমত ব্যানার্জিকে আমার মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করা হোক, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হোক। সেই মানুষটাই কী বেমালুম পাল্টে গেলেন। এখন টিভিতি বসে সরকারের একের পর এক ঘৃণ্য কাজের পক্ষে সাফাই গান। মুখ্যমন্ত্রীর তোষামোদ করেন।

একটা মানুষ এভাবে বদলে যায় কেন?‌ এই প্রশ্নটাই বারবার তাড়িয়ে বেড়াত। ভুল কিছুটা ভাঙল। এখন বলতে ইচ্ছে করে, টিভিতে যে কুণাল ঘোষকে দেখি, সেই কুণাল ঘোষকে আমি চিনি না। চিনতে চাই না। কারণ, আমি এক অন্য কুণাল ঘোষকে চিনেছি।

প্রতি রবিবার সংবাদ প্রতিদিনে চারের পাতায় তিনি একটা কলাম লিখছেন। ‘‌পথের বাঁকে এসে মনে হল’। মূলত সাংবাদিকতা জীবনের স্মৃতি নির্ভর কলাম। অকপটে স্বীকার করছি, আগে এই লেখা আমার নজরেই আসেনি। কারণ, আমি অন্য কাগজ পড়তাম। আলাদা করে সংবাদ প্রতিদিন পড়া হয়ে ওঠেনি। ওটা তো তৃণমূলের কাগজ— এই ভেবে একটা নাক সিঁটকানো ভাবও ছিল। সেই কারণেই হয়ত আরও বেশি করে পড়িনি। তাগিদ অনুভব করিনি।

একদিন কুণাল ঘোষ নিয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সে কথায় কথায় এই কলামটার কথা জানাল। বলল, পড়ে দেখ, এক অন্য কুণাল ঘোষকে চিনতে পারবি। এই লেখাগুলো পড়লে টিভির কুণাল ঘোষের ওপর আর রাগ হবে না। সেই বন্ধুই প্রায় তিরিশ খানা লেখার লিঙ্ক পাঠাল। একটা করে পড়তে দিন কয়েক লাগল।

সত্যিই বলছি, এই কুণাল ঘোষ আমার কাছে অচেনাই ছিল। আমি সাংবাদিক হিসেবে যে কুণাল ঘোষের লেখা পড়েছি, তাতে তাঁকে মমতার স্তাবকই মনে হত। বড্ড বেশি একপেশে মনে হত। আসলে, সেটা ২০০৬ পরবর্তী সময়ে। কিন্তু তার আগে যে তাঁর একটা বর্ণময় জীবন ছিল, সেই জীবনের হদিশ পাইনি। পাওয়ার চেষ্টাও করিনি।

মূলত, নয়ের দশকের শুরু থেকেই তাঁর সাংবাদিকতার শুরু। তখন তাঁর বয়স কত ছিল?‌ মেরেকেটে কুড়ি। তখন থেকেই এক তরুণের এত প্রভাব!‌ একদিকে সোমেন মিত্র, একদিকে মমতা ব্যানার্জি। একদিকে অনিল বিশ্বাস, একদিকে হাসিম আব্দুল হালিম। কখনও তপন শিকদার তো কখনও প্রণব মুখার্জি। সবার কাছেই তিনি এতখানি ভরসার পাত্র কীভাবে হয়ে উঠেছিলেন, তা ভাবলে সত্যিই বিস্মিত হই। একের পর এক এক্সক্লুসিভ খবর ও তার আড়ালে থাকা কাহিনী শুনে অদ্ভুত একটা শিহরণ আসছিল। ছোট ছোট বাক্য। কখনও নস্টালজিয়া। কখনও আবেগের স্রোত। কখনও অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সুন্দর মেলবন্ধন। অন্য এক কুণাল ঘোষকে যেন আবিষ্কার করলাম।

‌জেলের ভেতরের সেই দিনগুলির কিছুটা আভাস পেলাম। ওই কঠিন অবস্থা থেকেও কী দুরন্ত কামব্যাক। সৌরভ গাঙ্গুলির কামব্যাকের কথা আমরা জানি। এই কামব্যাকও কিন্তু কম গৌরবের নয়। জানি, এটা শুনলে অনেকে রে রে করে তেড়ে আসবেন। অনেকে আমাকেই গালমন্দ শুরু করে দেবেন। সেই ঝুঁকি নিয়েও এই লেখা লিখছি। জেলের ওই অন্ধকার সেল থেকেও কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, সত্যিই তার নিদর্শন হয়ে থাকতে পারেন এই মানুষটি। এই লেখাগুলো বই হয়ে বেরোলে, সেই বই কয়েকজনকে পড়ানোর ইচ্ছে আছে।

আবার বলছি, তিনি যে রাজনৈতিক বক্তব্য রাখেন, তার সঙ্গে আমি একেবারেই একমত নই। এই লেখাগুলো পড়ার পর মনে হচ্ছে, তিনি যেগুলো বলেন, তিনি নিজেও একমত নন। কোথাও একটা বাধ্যবাধকতা, কোথাও একটা দায়বদ্ধতা। তাই সেই মন্তব্যগুলিকে উপেক্ষাই করলাম। জেলের ভেতর বসে লেখা বইগুলো বরং পড়ার আগ্রহে থাকলাম। আরও এক নতুন কুণাল ঘোষ উন্মোচিত হোক।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.