অজয় নন্দী
শতাব্দীর সেরা ভারতীয় ফুটবলার কে? ফুটবল মহলে তর্ক থাকতেই পারে। ফিফা কিন্তু স্বীকৃতি দিয়েছিল শৈলেন মান্নাকেই। সেই কিনবদন্তি ফুটবলারের শতবর্ষ। কিন্তু বঙ্গজীবনে কোনও তাপ উত্তাপ নেই। কোনও চ্যানেলে সেই উল্লেখ নেই। কোনও কাগজেরও কোনও মাথাব্যথা নেই।
যত বড় ফুটবলার, ততই যেন আপনভোলা মানুষ। নিজের বাড়িও চিনতে পারতেন না। যখন কোনও অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে যেতেন, উদ্যোক্তারাই নিয়ে যেতেন। তাঁরাই দিয়েও যেতেন। তাঁর মানি ব্যাগে একটি কাগজে ঠিকানা লেখা থাকত। একটি কাগজের টুকরো আলাদা করে পকেটে ভরে দেওয়া হত। সেই চিরকুটে ঠিকানা ও বাড়ির ফোন নম্বর লেখা থাকত।
তাঁর স্ত্রী বা মেয়ে পইপই করে সেই উদ্যোক্তাদের বলে দিতেন, পকেটে ঠিকানা লেখা আছে। যদি ফেরার সময় চিনতে কোনও সমস্যা হয় বা অন্য গাড়িতে ফেরানো হয়, তাহলে অন্তত ঠিকানাটা যেন দেখে নেন। একবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। একটি অনুষ্ঠানে শৈলেন মান্না ও পিকে ব্যানার্জির যাওয়ার কথা। শৈলেন মান্না নিজের বাড়ি না চিনলেও পিকে ব্যানার্জি তাঁর বাড়ি চিনতেন। তিনি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছেন, কোন রাস্তা দিয়ে যেতে হবে।
এমন সময় শৈলেন মান্না বলে বসলেন, ওই যে চন্দন বসুর বাড়ি আছে। তার কাছেই আমার বাড়ি। ড্রাইভার বললেন, ‘এবার চিনতে পেরেছি।’ কিন্তু পিকে ব্যানার্জি গেলেন বেজায় ক্ষেপে। চিৎকার করে বললেন, ‘মান্নাদা, একটু আগে আপনি কী বললেন? চন্দন বসুর পাশে আপনার বাড়ি? আপনার লজ্জা করল না? কে চন্দন বসু। আপনি শৈলেন মান্না। এই দেশের সর্বকালের সেরা ফুটবলার। চন্দন বসু বলতে পারে, আমি শৈলেন মান্নার বাড়ির পাশে থাকি। তার জায়গায় আপনি কিনা বলছেন, চন্দন বসুর বাড়ির পাশে থাকি! চন্দন বসু কে? জ্যোতি বসুর ছেলে। এর বাইরে ওর কী আইডেন্টিটি আছে? যে টুকু আইডেন্টিটি, তাও ভাল কোনও কারণে নয়। জ্যোতি বসুর বাড়ির পাশে বললে তবুও না হয় একটা কথা ছিল। কিন্তু আপনাকে কিনা চন্দন বসুর রেফারেন্স দিতে হচ্ছে? এই জন্যই আমাজের কেউ সম্মান করে না।’
বেচারা শৈলেন মান্না। কী বলবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। আমতা আমতা করে বললেন, ‘আসলে, আমাদের তো কেউ চেনে না। চন্দন বসুর নাম বললে দেখেছি ড্রাইভাররা চিনতে পারে। তাই ওই নামটা বলি।’ কিন্তু পিকেও থামবার পাত্র নন। চিৎকার করেই গেলেন, ‘এই জন্যই আমাদের কেউ চেনে না। আমরা নিজেরাই চাই না, আমাদের লোকে চিনুক। স্বয়ং শৈলেন মান্না বলছেন, আমার বাড়ি চন্দন বসুর পাশে! জানেন, আইনস্টাইনও নিজের বাড়ি ভুলে যেতেন। উনি কী করতেন জানেন? উনি একে তাকে জিজ্ঞাসা করতেন, আচ্ছা, আইনস্টাইনের বাড়িটা কোনদিকে? পথচলতি লোক দেখিয়ে দিত। একবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। আইনস্টাইন একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, আইনস্টাইনের বাড়িটা কোনদিকে। সেই লোক তো বিরাট মেজাজ দেখালেন, ‘সে কী মশাই, আইনস্টাইনের বাড়ি চেনেন না? ওই তো, সোজা গিয়ে ডানদিকে।’ আইনস্টাইন ‘আচ্ছা, ধন্যবাদ’ বলে চলে গেলেন। সেই লোকটির কথা একবার ভাবুন, লোকটা আইনস্টাইনের বাড়ি চেনে না বলে স্বয়ং আইনস্টাইনকেই ধমকে দিল। অথচ, সেই লোক কিনা স্বয়ং আইনস্টাইনকেই চেনে না!
কিংবদন্তি শৈলেন মান্না শিশুর সারল্যে হেসে উঠলেন। কিন্তু পিকেও থামার লোক নন। ফিরে এলেন সেই প্রসঙ্গে, ‘তাহলে বুঝতে পারলেন? আর কখনও বলবেন না, আমি চন্দন বসুর বাড়ির পাশে থাকি।’ বেচারা শৈলেন মান্না। পিকে–কে থামতে ইশারা করে বললেন, আচ্ছা বাবা, আর বলব না।