টিকিটের লাইন দেখে গর্বিত নয়, লজ্জিত হতে শিখুন

ধীমান সাহা

ডার্বি মানেই এঁকে বেঁকে যাওয়া একটা লম্বা লাইন। কখনও সেই লাইন লাল হলুদ তাঁবুর সামনে। কখনও আবার সবুজ মেরুন তাঁবুর সামনে। সাতের দশক, আটের দশকে এটাই ছিল চেনা ছবি।

ডুরান্ডের ডার্বিতে আবার সেই দৃশ্য। অনেকেই যেন আবেগে আত্মহারা। আহা, সেই পুরনো উন্মাদনা ফিরে আসছে। তাঁবুর সামনে ঠায় রোদে দাঁড়িয়ে আছেন সমর্থকরা। এই দৃশ্য দেখার পর সেই সমর্থকদের কুর্নিশ করতে ইচ্ছে করে। সত্যিই তো, এরাই অক্সিজেন। এঁরা আছেন বলেই কলকাতায় ফুটবল এখনও সজীব।

কিন্তু মুদ্রার উল্টোপিঠের ছবিটাই বেশি করে ভাবাচ্ছে। একটা টিকিটের জন্য এত লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হবে কেন?‌ ভোর চারটে থেকে তাঁবুর সামনে ভিড় করতেই বা হবে কেন?‌ এত ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হবে কেন?‌ সমর্থকদের যদি কুর্নিশ জানাতে হয়, ঠিক ততটাই ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করে আয়োজকদের।

এত বছর ধরে শুনে আসছি, ডুরান্ড কাপ মানে সেটা সেনাবাহিনীর টুর্নামেন্ট। সেটা হয় দিল্লিতে। গত কয়েক বছরে যেন ছবিটা অন্যরকম। এখন কলকাতায় ডুরান্ড হচ্ছে। মোদ্দা কথা হল, সেনাবাহিনীর এখন আর সেই টুর্নামেন্ট আয়োজন করার ক্ষমতা নেই। আর্থিক ক্ষমতা হয়ত আছে। কিন্তু মাঠে লোক জড়ো হবে কী করে?‌

সেনা যেন রাজ্য সরকারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আর রাজ্য সরকারও এটাকে মমতা ব্যানার্জির সাফল্য হিসেবে দেখাতে মরিয়া। হোর্ডিং বা প্রচারের হাবভাব দেখে মনে হয়, এই ডুরান্ড কাপও হয়ত মমতা ব্যানার্জির অনুপ্রেরণাতেই শুরু হয়েছে। একদিন প্রেস কনফারেন্স হয়, মমতা ব্যানার্জিকে উদ্বোধনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আরেকদিন প্রেস কনফারেন্স হয়, মমতা ব্যানার্জি উদ্বোধন করতে রাজি হয়েছেন। ছেলেমানুষির চূড়ান্ত।

আবার সেই ডার্বির টিকিটের প্রসঙ্গে আসি। দায়িত্ব কার?‌ কৃতিত্ব নিতে সবাই তৈরি। কিন্তু দায় নিতে কেউই রাজি নন। সেনাবিহিনী দেখিয়ে দেয় রাজ্যকে। রাজ্য দেখিয়ে দেয় সেনাকে। ক্লাব দেখিয়ে দেয় রাজ্য ও সেনাকে। সবাই যদি দায় এড়াতেই ব্যস্ত থাকেন, তাহলে যা হওয়ার, তাই হয়। সুষ্ঠু সমাধানের বদলে সমস্যা বেড়েই চলে। দুই ক্লাবের সদস্যদের জন্য নাকি দেওয়া হয়েছে পাঁচ হাজার করে টিকিট। আর সমর্থকদের জন্য তেরো হাজার করে। অর্থাৎ, দুই ক্লাব মিলিয়ে ছত্রিশ হাজার টিকিটের একটা হিসেব পাওয়া যাচ্ছে। বাকি তিরিশ হাজার টিকিট গেল কোথায়?‌ কারা সেগুলো বিলি করলেন? কেচো খুঁড়তে গেলে নির্ঘাত কেউটে বেরিয়ে আসবে। দুই ক্লাবকর্তারা প্রশ্ন তুলবেন না। তোলার কথাও নয়। দাঁত কেলিয়ে তৃণমূলের মঞ্চে গেলে, এসব প্রশ্ন তোলার মুরোদ থাকে না।

যে কটা টিকিট পাওয়া গেল, সেগুলোও কি একটু সুষ্ঠুভাবে বিলি করা যেত না?‌ সহজ একটা অঙ্ক। কাউন্টারের সামনে ধরা যাক দু হাজার লোকের লাইন। সেই লাইন নিশ্চিতভাবেই এক কিলোমিটার ছাপিয়ে যাবে। আচ্ছা, যদি চারটে কাউন্টার থাকত, তাহলে কী হত?‌ সহজ হিসেব, ভিড়টা চার ভাগে ভাগ হয়ে যেত। লাইনগুলো এত লম্বা হত না। টিকিট পেতেও এত ভোগান্তি হত না। ক্লাব কর্তারা হাজার হাজার সমর্থকদের ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত লাইনে দাঁড় করাতে পারেন। কিন্তু কাউন্টারে চারজন কর্মী জোগাড় করতে পারেন না। এটা কার অপদার্থতা?‌

অথচ, এমন অপদার্থতার পরেও এই কর্তারা টিভির সামনে দাঁত কেলিয়ে বাইট দেন। সমর্থকদের উন্মাদনা দেখে আপ্লুত হওয়ার নাটক করেন। পরেরদিন কাগজে নিজেদের বিবৃতি দেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন।

সহজ কথা, পেশাদারি দক্ষতা থাকলে এই টিকিট বন্টন মসৃণভাবে হওয়া সম্ভব। কিন্তু এই কর্তাদের সেটা নেই। তাই সমর্থকদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এই লম্বা লাইন আবেগের বার্তা নয়। কর্তারা কতখানি অপদার্থ, তার বার্তা। এই লম্বা লাইন দেখে, গর্বিত নয়, কর্তারা একটু লজ্জিত হোন।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.