রঞ্জন ভট্টাচার্য
সেই শুরু করেছিলেন উত্তম কুমার। অবশ্য শুধু উত্তম কুমার কেন বলি, তার সঙ্গে যে সত্যজিৎ রায়ের নামও জড়িয়ে আছে। ফেলুদার স্রষ্টার হাত ধরেই পর্দায় ব্যোমকেশের আগমন। মাঝে লম্বা একটা বিরতি। তারপর নয়ের দশকে দূরদর্শনে হাজির বাসু চ্যাটার্জির ব্যোমকেশ বক্সি। সিরিয়ালটা যদিও হিন্দিতে, তবু রজিত কাপুরকে ব্যোমকেশ মানতে বাঙালির তেমন দ্বিধা ছিল না।
তার পরেও লম্বা বিরতি। কিন্তু তার পর থেকেই যেন ব্যোমকেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি এসে গেল। কখনও অঞ্জন দত্ত, কখনও অরিন্দম শীল, যে পারলেন, একটা করে ব্যোমকেশ বানিয়ে দিলেন। ব্যোমকেশের ভূমিকায় কোথাও আবীর, তো কোথাও যিশু। একে একে কেউই বাদ গেলেন না। অবশেষে বৃত্ত সম্পূর্ণ। কারণ, এবার ব্যোমকেশের ভূমিকায় দেব।
আসলে, ফেলুদা–ব্যোমকেশ নামগুলোর সঙ্গে বাঙালির এমন কিছু নস্টালজিয়া রয়ে গেছে, পান থেকে চুন খসলেই নানা সমস্যা। বিশেষ করে দেব যখন ব্যোমকেশের ভূমিকায়, তখন ‘গেল গেল’ রব তোলার লোকেরও অভাব নেই। আবার যাঁরা দেবের অনুরাগী, তাঁরা অন্য দেবকে দেখতে অভ্যস্থ। তাঁদের আবার এই বদলে যাওয়া দেবকে কতখানি ভাল লাগে, সেটাও বড় প্রশ্ন।
যাই হোক, বিরসা দাশগুপ্তর পরিচালনায় দেব মোটামুটি উতরে গেছেন। দুর্গরহস্য যত না উপন্যাস হিসেবে বিখ্যাত, সানডে সাসপেন্সের জন্যও কম বিখ্যাত নয়। ফলে, গল্প মোটামুটি অনেকেরই জানা। আসলে, ব্যোমকেশ বলতে যে টিপিক্যাল বাঙালিয়ানা মনে পড়ে, এখানে তার ধারপাশ দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করেননি পরিচালক। দেবও কাউকে নকল করার কোনও চেষ্টা করেননি। করেছেন নিজের মতো করে। তাই অনেক জায়গায় গল্পের সঙ্গে মেলেনি। মেলার কথাও নয়।
দেবকে এখানে লার্জার দ্যান লাইফ হিসেবেই দেখানো হয়েছে। তাঁর আগমনের মধ্যেও যথেষ্ট সাসপেন্স আছে। ধুতি নয়, এখানে প্যান্ট শার্টই পরানো হয়েছে। তাছাড়া, ব্যোমকেশ মানেই অনেকটা অংশ ঘরের ভেতর। এখানে ঘরের বাঁধন ছেড়ে একটু বাইরের হাতছানি। নাম দুর্গরহস্য। সেই রহস্যের কিনারা করতে যেমন দুর্গের নানা প্রান্তে যেতে হয়েছে, তেমনই বাইরে খোলা জায়গাতেও পৌঁছে গেছে ক্যামেরা।
ইতিহাসের কিছু অংশ আছে। পলাশির যুদ্ধ যেমন আছে, তেমনই আছে তার একশো বছর পরের সিপাহি বিদ্রোহের কথাও। এমন দৃশ্যপট আনাটা বেশ খরচসাপেক্ষ। বোঝাই যাচ্ছে, প্রযোজক দেব কার্পণ্য করেননি। বাজেট সীমিত রাখার চেষ্টা করেননি। তাছাড়া, যেখানে ব্যোমকেশ হিসেবে দেবকে নেওয়া, সেখানে কার্পণ্য থাকার কথাও নয়।
তবে ব্যোমকেশ মানে তো শুধু ব্যোমকেশ নয়। সঙ্গে থাকা অজিতের ভূমিকায় অম্বরীশ ভট্টাচার্য। কমেডির জন্যই অম্বরীশের পরিচিতি। কিন্তু এখানে কিছুটা গণ্ডগোল করে ফেলেছেন চিত্রনাট্যকার। অজিতের ভূমিকায় অম্বরীশ, এটা সবসময়ই মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে। ফলে, অজিতকে দিয়ে অহেতুক কমেডি করানো হয়েছে। ফলে, অজিত যতটা না অজিত, তার থেকে যেন বেশি জটায়ু। শরদিন্দুর অজিত নিজে একজন লেখক। যথেষ্ট বিচক্ষণ। কিন্তু তাঁকে দিয়ে কমিক রিলিফ আনাতে গিয়ে বুদ্ধিতে বা ব্যক্তিত্বে কোথায় যেন টান পড়ে গেল। আর সত্যবতী। আসল গল্পে সত্যবতীর কথা ছিল না। এখানে পরিচালক আনতেই পারেন। কিন্তু দেব নিলে যেন রুক্মিনি ফ্রি। মানে, রুক্মিনিতে নিতে হবে, তাই সত্যবতীকে আনা। অন্য জায়গায় সত্যবতীকে যেমন বুদ্ধিমতি মনে হয়, এক্ষেত্রে মোটেই তেমনটা হয়নি। বরং, অনেক বেশি ন্যাকামি প্রকাশ পেয়েছে। সবার জন্য সব চরিত্র নয়, এটা বুঝিয়ে দিতে রুক্মিনি বেশ ‘সফল’।
একটা গল্প দাঁড়িয়ে থাকে মূলত চিত্রনাট্যের ওপর। কিন্তু এখানে সেই চিত্রনাট্য বড়জোর দশে পাঁচ পেতে পারে। আর দশটা ব্যোমকেশের সঙ্গে দেবের ব্যোমকেশ হওয়ার একটা তফাত আছে। থাকবেও। পর্দায় দেবের উপস্থিতি একটু বেশি থাকবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু একটা গল্প তো শুধু গোয়েন্দা কেন্দ্রিক নয়। গল্প এগোয় নিজের নিয়মে। অন্য চরিত্রেরও অনেক কিছু বলার থাকে। সম্পর্কের জটিল রসায়ন থাকে। সেগুলো কোথাও একটা উপেক্ষিত থেকে গেছে। শুরু থেকেই দর্শকের কাছে অহেতুক কিছু গোপনীয়তার পর্দা ঝোলানো হয়েছে। গোয়েন্দা সিনেমার সাফল্যের চাবিকাঠি হল, দর্শক নিজেও নিজেকে ছোটখাটো গোয়েন্দা ভাববেন। তিনিও তাঁর মতো করে সমাধান করতে করতে এগোবেন। কোথাও সেই ধারনা মিলবে, কোথাও হয়ত মিলবে না। অর্থাৎ, মোদ্দা কথা, দর্শককে আরও একাত্ম করা। কিন্তু এখানে চিত্রনাট্যের জটিলতায় দর্শক শুরু থেকেই তেমন একাত্ম হতে পারছেন না। মনে হবে, ধুর, কিছুই বুঝতে পারছি না। শেষবেলার জন্য অপেক্ষা করার ছাড়া তার আর কিছু করার থাকছে না। সে কখনই গল্পের সহযাত্রী হতে পারছে না। এই জায়গায় মস্তবড় একটা ফাঁক থেকে গেল।