পরিচালকদের কাজটা আশি ভাগ এগিয়ে রাখল ‘‌নিয়তি’‌

বুক প্রিভিউ

স্বরূপ গোস্বামী

বুক রিভিউ সাধারণত বই পড়ার পরেই লেখা হয়। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় থাকে, কিছু কিছু বই থাকে, যা পড়ার আগেই তার স্পন্দন অনুভব করা যায়। তেমনই একটি বই ‘‌নিয়তি।’‌ তাই বুক রিভিউ না বলে এই লেখাকে বুক প্রিভিউ–‌ও বলা যায়।

নামটা শুনে মনে হতেই পারে, কোনও ধর্মীয় বা ভৌতিক বিষয় নিয়ে বই। একেবারেই তা নয়। একেবারে সবুজ ঘাসের গন্ধ মাখা, খেলার মাঠের বই। ইডেনের একটি অভিষপ্ত দিন ও তার নানা উপাখ্যান। সময়ের দলিল হয়ে ওঠা আস্ত এক উপন্যাস। মৃত্যুর কথা। আসলে, মৃত্যুকে ছাপিয়ে জীবনের কথা।

পরপর দু’‌বছর বইমেলায় দু’‌খানা বই। একটির বিষয় মোহনবাগান। অন্যটির ইস্টবেঙ্গল। দুটিতেই দারুণ সাড়া ফেলেছেন অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়। দুই দশক ধরে মূলস্রোত সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। তারও আগে, বাবার হাত ধরে যুবভারতীতে ম্যাচ দেখতে আসা। কৈশোর থকেই মোহনবাগান শব্দটা যেন মনের মধ্যে গেঁথে যাওয়া। ময়দানের পরিচিত নামগুলো শুরু থেকেই মনের মধ্যে উঁকি দেওয়া।

সেই আবেগটাই টেনে এনেছিল ক্রীড়া সাংবাদিকতায়। প্রেসবক্সের ঠান্ডা ঘর ছেড়ে মাঝে মাঝেই বেরিয়ে যেতেন কোলাহল মুখর গ্যালারিতে। কখনও ঘুগনি বিক্রেতার সঙ্গে, কখনও লজেন্স মাসির সঙ্গে জুড়ে দিতেন গল্প। কোন ছেলে বাবার চিতায় আগুন দিয়ে মাঠে চলে এসেছে, কে ডার্বি দেখবে বলে বিয়ের দিন পিছিয়ে দিল, এই চরিত্রগুলোকে নিজের মতো করে চিনতে চেয়েছেন, বুঝতে চেয়েছেন। তাই তাঁর দু’‌খানা বই নিছক তথ্যনির্ভর প্রবন্ধের বই নয়। ব্যাখ্যা নির্ভর ইতিহাসও নয়। খেলোয়াড়দের গল্প, সমর্থকদের গল্প হয়ে উঠেছে। যে যাঁর মতো করে একাত্ম হয়েছেন।

এবার একটু সাহস করে আরও একটা বড় কাজে হাত দিয়েছেন। ১৯৮০–‌র সেই ষোলই আগস্টকে নিয়ে লিখে ফেললেন আস্ত একটা উপন্যাস। এই উপন্যাস লেখার যোগ্য লোক আগে হয়ত অনেকেই ছিলেন। বিশেষ করে যাঁরা সেই সময় চুটিয়ে সাংবাদিকতা করেছেন। তাঁদের পক্ষে কাজটা হয়ত কিছুটা সহজও হত। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, তাঁরা সেই তাগিদ অনুভব করেননি। সেই জটিল কাজে হাত দিয়েছেন অর্ঘ্য।

সেই ঘটনা যখন ঘটে, তখন লেখকের বয়স কত?‌ এক বা দুই বছর। ফলে, ঘটনার তাৎক্ষণিক কোনও অভিঘাত থাকার কথা নয়। দেরিতে জন্ম হওয়াটা তো লেখকের দোষ হতে পারে না। বরং, তার দু’‌দশক পরে সাংবাদিকতায় এসেও যে সেই ঘটনার সঙ্গে একাত্ম হওয়া যায়, সেটা অর্ঘ্য বুঝিয়ে দিলেন। আসলে, এটা হঠাৎ করে লিখে ফেলা কোনও বই নয়। সলতে পাকানোর পর্বটা অন্তত দু’‌দশকের। কিশোর বেলা থেকেই এই মর্মান্তিক ঘটনার কথা শুনেছেন। পরে সাংবাদিকতায় এসে বছরের পর বছর স্বজনহারানো পরিবারগুলোর সঙ্গে মিশেছেন। তাঁদের স্বজনহারানোর যন্ত্রণা অনুভব করেছেন। যাঁরা সেদিন খেলেছিলেন, কালো পোশাক পরে যাঁরা রেফারির ভূমিকায় ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে দু’‌দশক ধরে মিশেছেন। নিছক সেলফি তুলে দায় সারেননি। ‘‌এই সময়’‌ এ বাস করেও, সেই সময়ের নানা গল্প খুঁটিয়ে বের করেছেন। মরমী মনে তা অনুভব করেছেন।

রোদে পুড়ে, জলে ভিজে মানুষ কেন খেলা দেখতে আসে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেন লাইন দিয়ে টিকিট কাটে। ঘোড়া–‌পুলিশের তেড়ে আসা দেখেও সে কীভাবে নির্ভিক হয়ে একটা টিকিটের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। এইসব অনুভূতিগুলো সংবেদনশীল সাংবাদিক অর্ঘ্যর অচেনা নয়। বছরের পর বছর, এই অনুভূতিগুলোই উঠে আসে তাঁর নানা প্রতিবেদনে। সেলফি আর ফেবু ম্যানিয়ায় আক্রান্ত এই প্রজন্মের খুব কম সাংবাদিককেই এই অনুভূতিগুলো ছুঁয়ে যায়। অর্ঘ্যর একটা সম্পদ যদি হয় ময়দানের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ, তাহলে অন্য সম্পদ হল নির্মেদ ও ঝরঝরে ভাষা। সেইসঙ্গে গুছিয়ে গল্প বলার মুন্সিয়ানা। একসঙ্গে এতরকম সম্পদ নিয়ে ময়দানে আর কেউ বিরাজ করছেন!‌ সত্যিই জানা নেই।

হ্যাঁ, এমন একটা বিষয় নিয়ে উপন্যাসের মোড়কে একটা প্রামাণ্য দলিলের দরকার ছিল। এবং এই প্রজন্মের সাংবাদিকদের মধ্যে অর্ঘ্যই সেই কাজের যোগ্যতম ব্যক্তি। আসল কথা, পড়া, পড়া এবং পড়া। যে অভ্যেসটা কমতে কমতে প্রায় লুপ্তই হতে বসেছে। অর্ঘ্যর মধ্যে পড়াও আছে, শোনাও আছে। তাই সুপর্ণকান্তির তৈরি গানও অনায়াসে প্রতিবেদনের বিষয় হিসেবে উঠে আসে। ষোল আগস্ট প্রতিবছরই আসে, যায়। কই, আর কারও মধ্যে তো এমন ভাবনা দেখি না। উপন্যাসে এই গানের কথা থাকবে!‌ থাকারই কথা। সেই গানটাও তো সেই সময়েরই কথা বলে। নানা আঙ্গিক থেকে ঘটনাকে দেখা। নানা আঙ্গিক থেকে সেই ফুটবল অনুরাগকে ছুয়ে দেখা। আসলে, টাইম মেশিনে চড়ে সেই সময়টাকেও ছুয়ে দেখা। সঙ্গে কোথাও কোথাও সোনায় খাদ মেশানোর মতোই কল্পনার রঙ মেশানো। আসলে, ৪৩ বছর পর কোনও ঘটনার পুনর্নির্মাণ করতে গেলে অনেক মিসিং লিঙ্ক থেকে যায়। সেগুলোকে জুড়তে কল্পনার এই মিশেলটাও জরুরি। নইলে তা আলুবিহীন বিরিয়ানির মতো বেমানান হয়ে যাবে।

নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এই বইয়ে কোনও নায়ক থাবে না, কোনও ভিলেনও থাকবে না। থাকবে টুকরো টুকরো কিছু ছবি। আর সব ছবির কোলাজে ‘‌নিয়তি’‌ হয়ে উঠবে একটা বিরাট ক্যানভাস। ‘‌এগারো’‌ যদি সেলুলয়েডে ধরা দেয়, তাহলে ষোল আগস্ট বিষয় হবে না কেন?‌ নতুন প্রজন্মের পরিচালকরা এখন থেকেই চোখ রাখুন। তাঁদের হয়ে গবেষণার কাজটা অর্ঘ্যই করে দিয়েছেন। তাঁরা শুধু দ্রুত ছবির সত্ত্ব কিনে ফেলুন। হ্যাঁ, বই বাজারে আসার আগেই।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.