সেই ঠিকানা লেখা স্বপ্নের পাস

সজল সেনগুপ্ত

আমার জন্ম ছয়ের দশকে। স্বভাবতই বেড়ে ওঠা সাতের দশকে। তখনও টেলিভিশন নামক যন্ত্রটা আমবাঙালির ঘরে পৌঁছয়নি। আর মফস্বল তো টেলিভিশনের বৃত্ত থেকে অনেক দূরে। ফলে, তখন আমাদের বন্ধু ছিল রেডিও।

ছোট থেকেই খেলায় নেশা। খেলা বলতে মূলত ফুটবল। ফলে, খুব ছোট থেকেই সুরজিৎ, সুব্রত, প্রসূন, গৌতম নামগুলোর সঙ্গে পরিচিতি। এঁরাই তখন আমাদের চোখে স্বপ্নের নায়ক। তখনও খবরের কাগজে খেলা নিয়ে খুব বেশি লেখালেখি হত না। ভরসা ছিল সেই রেডিও। অজয়র বসুর সেই উদাত্ত কণ্ঠ। খেলাকে যেন বাঙালির রান্নাঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

আমি ছিলাম মোহনবাগান সমর্থক। আজও তাই আছি। কিন্তু মোহনবাগানকে ভালবাসি বলে ইস্টবেঙ্গলের কাউকে ভালবাসা যাবে না, এমন কট্টর সমর্থক অবশ্য ছিলাম না। তাই সুরজিৎ সেনগুপ্তর কোনও দুরন্ত ড্রিবলিং বা গৌতম সরকারের স্ন্যাচিংয়ের কথা শুনেও উল্লসিত হতাম। এমনকী মোহনবাগান সমর্থক হলেও ইস্টবেঙ্গলের খেলার ধারাবিবরণীও মন দিয়ে শুনতাম। মনে হত, ইস, এই লোকটা যদি আমাদের ক্লাবের জার্সিতে খেলত, কী ভালই না হত!‌

গৌতম সরকারের লড়াকু ফুটবল আমাকে খুব উজ্জীবিত করত। একসময় ইস্টবেঙ্গলের জার্সি ছেড়ে মোহনবাগানের জার্সিতেও এলেন গৌতম। তখন আরও বেশি করে অনুরাগী হয়ে পড়লাম। ততদিনে তাঁকে ভারতের বেকেনবাওয়ার বলছেন কেউ কেউ। ছোটখাটো চেহারা। কিন্তু কী দুরন্ত সাহস। পেলের পা থেকেও বল ছিনিয়ে নিচ্ছেন। হার না মানা সেই মনোভাব। পাড়ার মাঠে যখন বড়দের সঙ্গে খেলতাম, অনেকের পা থেকে বল ছিনিয়ে নিতাম। মনে পড়ত সেই গৌতম সরকারের মুখটাই। মনে হত, আমিও পেরেছি। লোকটার নামের পাশে হয়ত বিরাট সংখ্যক গোল নেই। আসলে, কেউ কেউ থাকেন, অন্যকে দিয়ে গোল করিয়েই আনন্দ পান। তাই অন্যের জন্য ঠিকানা লেখা পাস বাড়ান। অনেক বড় মনের মানুষ না হলে এমন ঠিকানা লেখা পাস বাড়ানো যায় না।

সেই গৌতম সরকারকে এবার দেওয়া হল মোহনবাগান রত্ন। মোহন–‌কর্তাদের ধন্যবাদ। এই প্রজন্মের কাছে গৌতম সরকার নামটা কতখানি আলোড়ন তোলে, জানি না। তবে, আমাদের কাছে এই নামটার গুরুত্ব অনেক। কারণ, আমাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে, আমাদের স্বপ্ন দেখার সঙ্গে এই নামগুলো জড়িয়ে আছে।

এভাবেই একজন ফুটবলার শুধু একটা ক্লাবের হয়ে খেলেন না। আরও হাজার হাজার কিশোর, তরুণের মধ্যে ছড়িয়ে থাকেন। সাতের দশকে জন্ম নেওয়া অনেকেরই নাম গৌতম। নামটা এতটাই প্রচলিত, এর উৎস আমরা ভেবেও দেখি না। কিন্তু কার নাম অনুসারে গৌতম?‌ আমরা ভেবে নিই, হয়ত গৌতম বুদ্ধের নামে। কিন্তু সত্যিই কি তাই?‌ যিনি পাগলের মতো ফুটবল ভালবাসেন, তিনি যখন ছেলের নাম গৌতম রাখছেন, অবচেতনে কি এই লড়াকু ফুটবলারের নামটা মনে আসেনি?‌

আমার দুই মামার ছেলের নাম বিদেশ, মানস। একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন তো, বিদেশের সঙ্গে কোন যুক্তিতে মানস নামটা আসে!‌ আসে সাতের দশকের ওই ফুটবল উন্মাদনা থেকেই। সেই সময় দেওয়া সুরজিৎ, প্রসূন, সমরেশ, গৌতম, সুব্রত নামগুলোর মধ্যেই ছড়িয়ে আছে ময়দানের সেই উন্মাদনা। এটা নিয়ে সত্যিই একটা সমীক্ষা হওয়া দরকার।

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.