কমরেড, ডিম–‌ভাতের বৃত্ত থেকে এবার বেরিয়ে আসুন

আজ যাঁরা নানা বাধ্যবাধকতায় ব্রিগেডে, তাঁদের অনেকেই এখনও মনে মনে লাল পতাকা নিয়েই হাঁটছেন। আবার একদিন লাল পতাকার নিশ্চিত আশ্রয়েই ফিরে আসবেন। সেই গরিব গুর্বো মানুষগুলোর ডিম–‌ভাত খাওয়াকে কটাক্ষ করতে গিয়ে তাঁদের আরও দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন না তো?‌ ডিম–‌ভাত নিয়ে হইচই করতে গিয়ে আসল সমালোচনার জায়গাগুলো আড়াল করে ফেলছেন না তো?‌ লিখেছেন রক্তিম মিত্র।।

একুশে জুলাই এলেই একটি অদ্ভুত শব্দবন্ধ এসে হাজির হয়ে যায়। ডিম–‌ভাত। বিজেপির কর্মীরাও বলে থাকেন। প্রবল উৎসাহে বাম কর্মীরাও বলে থাকেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই শব্দ দুটো কত লক্ষবার যে লেখা হয়, তার কোনও হিসেব থাকে না।

অনেকে ভেবে নেন, ‘‌ডিম–‌ভাত’‌ বললেই বোধ হয় দারুণ প্রতিবাদ হয়ে গেল। অনেকে ভাবেন, এটা বললেই বোধ হয় নিজেকে দারুণ আপডেটেড হিসেবে জাহির করা গেল। একুশে জুলাইয়ের কয়েকদিন আগে থেকেই এই প্রচার শুরু হয়। একুশে জুলাই সারাদিন ধরে এটাই চলতে থাকে। পেরিয়ে যাওয়ার তিন–‌চারদিন পরেও রেশ থেকে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না।

মূলস্রোত মিডিয়াতেও সেই ‘‌ডিম–‌ভাত’‌ এর চর্চা। সন্ধের আলোচনায় যাঁরা আসেন, তাঁরাও এটা নিয়েই মত্ত থাকেন। একবার ভেবেও দেখেন না, এই শব্দ বন্ধটা ব্যবহার করে কাদের ছোট করছেন। কাদের আরও দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন। এই লঘু দুটো শব্দ ব্যবহার করে কাদের আড়াল করছেন। বুঝে হোক, না বুঝে হোক, বামপন্থীরাও এই গড্ডালিকা প্রবাহেই ভেসে যাচ্ছেন।

গ্রামের গরিব মানুষদের হেয় করা শহুরে বাঙালির অনেকদিনের ট্র‌্যাডিশন। কোনও সভা বা মিছিল মানেই প্রচার হয়, গ্রামের লোক ট্রেনে চড়তে পায় না। কলকাতা শহর ঘুরতে এসেছে। মাছ–‌ভাত, ডিম–‌ভাত খাওয়ার লোভে এসেছে। বামেদের ব্রিগেডের ক্ষেত্রেও দিনের পর দিন এমন প্রচার হয়েছে, তৃণমূলের সমাবেশের ক্ষেত্রেও হচ্ছে।

হ্যাঁ, গ্রামের মানুষ ব্রিগেডে আসেন। বছরের পর বছর তাঁরাই ব্রিগেড ভরিয়ে এসেছেন। কলকাতার সুখী মানুষেরা ড্রয়িং রুমে বসে থাকবেন, সোশ্যাল সাইটে কটাক্ষ ছুঁড়বেন। কিন্তু লড়াইয়ের ময়দানে থাকবেন না। লড়াই করার জন্য, ভিড় জমানোর জন্য এগিয়ে দেওয়া হয় সেই গ্রামের মানুষকেই। আর আমরাও কটাক্ষের জন্য বেছে নিই ওই গ্রামের মানুষকেই। তাঁদের ডিম–‌ভাত খাওয়াটাকেই বড় করে দেখি। সেটাই বড় করে দেখানো হয়।

যাঁরা আসেন, কেউ ভালবেসে আসেন। কেউ আবার বাধ্য হয়েও আসেন। মনে রাখবেন, কোনওরকম জনভিত্তি ছাড়া এত বড় জমায়েত হয় না। আবার এটাও ঠিক, সরকারে থাকার সুবাদে অনেক মানুষ অনেকরকম সুবিধা পেয়েছেন। তাঁদের কাছে তার পাল্টা কড়ায় গন্ডায় আদায় করে নেওয়া হয়। যাঁর মেয়ে কন্যাশ্রীর সাইকেল পেয়েছে, যিনি ‘‌আমার বাড়ি’‌ প্রকল্পে বাড়ি পেয়েছেন, কারও নামে একশো দিনের কাজের জবকার্ড, সেখানে টাকাও ঢোকে। যাঁরা পঞ্চায়েতের সুবাদে নানা সুবিধা পেয়েছেন, তাঁদের ওপর কম–‌বেশি একটা চাপ থেকেই যায়। সেই কৃতজ্ঞতা হিসেবে তাঁদের আসতে হয়।

আবার কারও ক্ষেত্রে সেই সুবিধার টোপ ঝোলানো হয়। যদি ছেলেটার সিভিক পুলিসে চাকরি হয়, যদি মেয়েটা কোথাও একটা কাজ পায়, এসব প্রত্যাশাও হয়ত অনেকের থাকে। যাঁরা আসছেন, তাঁরা সবাই যে তৃণমূল–‌পন্থী, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। অনেকের সামনে অনেক রকম বাধ্যবাধকতা। হয়ত মনে মনে অনেকেই এখনও লাল পতাকাটাই ধরে আছেন। ঠিকঠাক ভরসার জায়গা তৈরি হলে, এঁদের অনেকেই হয়ত আবার সেই লাল পতাকাই তুলে নেবেন। ডিম–‌ভাত নিয়ে কটাক্ষ করতে গিয়ে সেই মানুষগুলোকে আরও দূরে ঠেলে দিচ্ছেন না তো!‌

তৃণমূলের একুশে জুলাই সমাবেশে কত খরচ হয়, তার কোনও হিসেব নেই। এমনকী তৃণমূল নিজেও সেই হিসেব খুঁজে পাবে না। কারণ, কোথায় কত খরচ, তা লিখে রাখার জন্য চিত্রগুপ্তের খাতাও যথেষ্ট নয়। কোন কোন খাতে খরচ হয়, তার ছোট্ট কয়েকটা নমুনা তুলে ধরা যাক।

১)‌ উত্তরবঙ্গের লোকেরা মূলত ট্রেনেই আসেন। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে বিরাট অংশের মানুষকে বাসেই আসতে হয়। বিভিন্ন জেলা থেকে কম–‌বেশি ছশো থেকে আটশো বাস আসে। পুরুলিয়া থেকে কলকাতা আসতে হলে একটি বাসের দুদিনের ভাড়া কত?‌ অন্তত তিরিশ হাজার। আটশো বাসের ভাড়া তাহলে কত?‌ প্রায় আড়াই কোটি। প্রায় সব জেলা থেকেই বাস বাবদ খরচ দু কোটির মতো। যে বাস মালিক বাস দিলেন, তিনি কি আদৌ টাকা পেলেন?‌ কেউ হয়ত তেলের দাম পেলেন। কেউ তাও পেলেন না। তিনি জানেন, এই দিনে বাস না দিলে এলাকায় বাস চালানোই মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। অনেক সরকারি বাসও তুলে নেওয়া হয়েছে। যার ভাড়া জমা পড়েনি। সবমিলিয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে বাস বাবদ খরচ অন্তত তিরিশ কোটি।

২)‌ তৃণমূলের জেলা স্তর তো ছেড়ে দিন। ব্লক স্তর, এমনকী পঞ্চায়েত স্তরের নেতারাও বাস বা ট্রেনে চড়া ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁরা নিদেনপক্ষে স্করপিও, বোলেরো ছাড়া কলকাতায় আসার কথা ভাবতেই পারেন না। বিভিন্ন জেলা থেকে এমন কত গাড়ি এসেছে?‌ উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোকে যদি হিসেবের বাইরেও রাখেন, তাহলেও এমন গাড়ির সংখ্যা জেলাপিছু অন্তত হাজার। নেতার সঙ্গে সাঙ্গোপাঙ্গোরাও থাকেন। তাঁরা কিন্তু ডিম–‌ভাতের বান্দা নন। সেন্ট্রাল পার্ক বা গীতাঞ্জলি স্টেডিয়ামে থাকার পাবলিকও নন। খাদ্য–‌পানীয় ও কলকাতার এসি হোটেলের খরচ মিলিয়ে কত দাঁড়াতে পারে?‌ অন্তত পঞ্চাশ কোটি।

৩)‌ যারা নানা সরকারি কাজের বরাত পেয়েছেন, দশ হাজার খরচ করে দশ লাখের বিল ধরিয়েছেন, তাঁরা এই সময় কী কী প্রতিদান ফিরিয়ে দিলেন, তার কোনও স্পষ্ট হিসেব থাকা সম্ভব নয়।

৪)‌ এত এত প্যান্ডেল। থাকার ব্যবস্থা। যাঁরা করলেন, ঠিকঠাক টাকা পেলেন তো?‌ তাঁরা আগে সরকারি কাজের বরাত পাননি তো?‌ সেখানে বড় অঙ্কের বিল করে এখানে সেটা পুষিয়ে দিলেন না তো? টাকা দেওয়া হোক বা না হোক, এত এত প্যান্ডেলের আনুমানিক বিল কত হতে পারে?‌ অন্তত কুড়ি কোটি।

‌৫)‌ গোটা কলকাতা শহর পিসি–‌ভাইপোর হোর্ডিংয়ে ছেয়ে গেছে। জেলায় জেলায় ছড়িয়ে আছে। এইসব হোর্ডিংয়ের খরচ কত?‌ যদি পুরসভাকে তার ট্যাক্স দিতে হত, তাহলে সেই ট্যাক্স বাবদ কত দিতে হত?‌ এইসব হোর্ডিং স্থানীয় নেতারা নিজেদের উদ্যোগে টাঙিয়েছেন। পুরসভায় রাজস্ব বাবদ কিছুই জমা পড়েনি। যাঁরা এত এত হোর্ডিং টাঙালেন, তাঁরা কারা?‌ যাঁরা সারা বছর লক্ষ লক্ষ হোর্ডিংয়ের বরাত পান, তাঁদের অদৃশ্য সাহায্য নেই তো!‌ একটু ঠান্ডা মাথায় হিসেব করুন। এই হোর্ডিংয়ের খরচ ও রাজস্ব ফাঁকি মিলিয়ে এই অঙ্কটা নিশ্চিতভাবেই একশো কোটি ছাপিয়ে যাবে।

৬)‌ যে সব প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া টানা কয়েকদিন ধরে প্রচার করে গেলেন, তাঁরাও বিনামূল্যে করলেন, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। একুশে জুলাইয়ের জন্য আলাদা করে হয়ত বিজ্ঞাপন দিতে হয়নি। আসলে, সারা বছর ধরে কোটি কোটি টাকার সরকারি বিজ্ঞাপন পেয়ে আসছেন। সেই কৃতজ্ঞতা ফিরিয়ে দেওয়ার তাগিদ থাকাটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ, চার–‌পাঁচদিন আগে থেকে যে এত প্রচারের ঢক্কা নিনাদ, তা কিন্তু সেই বিজ্ঞাপনের জন্যই। এই টাকাও কিন্তু গেছে জনতার ট্যাক্সের টাকা থেকেই। এই অঙ্কটা?‌ এটাও কিন্তু একশও কোটির কম হবে না।

৭)‌ যে সমস্ত সরকারি হল ব্যবহার করা হল, সেগুলোর ঠিকঠিক অনুমতি নেওয়া হয়েছিল তো?‌ তার জন্য যা ভাড়া, সেটা সরকারি খাতে জমা হয়েছে তো?‌ ধরা যাক, সেন্ট্রাল পার্ক। বইমেলায় একটা দশ ফুট বাই দশ ফুটের স্টল নিতে কত খরচ পড়ে?‌ সেখানে পুরো মাঠটা প্রায় সাতদিন ধরে নিলে কত খরচ হতে পারে?‌ বিধাননগর পুরসভায় সেই টাকা জমা পড়েছে তো?‌

৮)‌ দলের কাজে কয়েক মাস ধরে এত এত পুলিশকে খাটানো হল, পুলিশে পুলিশে এলাকা মুড়ে ফেলা হল, তার জন্য পুলিশের কত তেল পুড়ল, কত কর্মদিবস নষ্ট হল, কে জানে‌!‌‌

আরও এমন অনেক খাত আছে, যেখানে খরচের হিসেব নেই। হিসেব থাকার কথাও নয়। সব খরচ ধরলে নিশ্চিতভাবেই তা পাঁচশো কোটি ছাপিয়ে যেতেই পারে।

আর ডিম–‌ভাতের খরচ?‌ ধরে নিলাম, সব মিলিয়ে কুড়ি হাজার মানুষ ডিম–‌ভাত খেয়েছেন। মিল পিছু পঞ্চাশ টাকা ধরলেও অঙ্কটা দশ লাখ। দুদিন চার বেলা মিলিয়ে ধরলে চল্লিশ লাখ।

তাহলেই ভেবে দেখুন, যেখানে অন্তত পাঁচশো কোটি খরচ, সেখানে এই ডিম–‌ভাতের চল্লিশ লাখ খরচটাই আপনার চোখে পড়ল। আক্রমণের জন্য ওই গরিব গুর্বো, অসহায় মানুষগুলোর মুখই আপনার মনে পড়ল। ডিম ভাতের চল্লিখ লাখ নজরে এল, হোর্ডিংয়ের একশো কোটি নজরেই এল না। এত এত গাড়ি, বিলাসবহুল হোটেলের খরচ আপনার চোখেই পড়ল না।

যাঁরা ডিম–‌ভাত নিয়ে দিনরাত কটাক্ষ করছেন, তাঁরা ভেবে দেখুন, এই বিষয়টা নিয়ে কটাক্ষ করতে গিয়ে নিজেদের প্রচারকে কত লঘু করে তুলছেন!‌ কয়েক লাখ খরচের জন্য হইচই করতে গিয়ে কয়েকশো কোটিকে পেছনে ফেলে এলেন।

কমরেড, ডিম–‌ভাতের বৃত্ত ছেড়ে এবার একটু বেরোন। ভাবুন, ভাবুন, ভাবা প্র‌্যাকটিস করুন। ‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.