স্বরূপ গোস্বামী
তিনি যথারীতি সেই পুরনো ফর্মে। পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক আগে, সেই পেটোয়া চ্যানেলে। যেখানে প্রশ্নের নামে আসবে একের পর এক ফুলটস বল। আর তিনি মনের সুখে ব্যাট চালাবেন।
জানিয়ে দিলেন, এত আসনে বিরোধীরা কখনও প্রার্থী দিতে পারেনি। আর সঞ্চালকও দন্ত বিগলিত করে সেসব শুনে গেলেন। তালে তাল দিয়ে যাওয়া ‘হ্যাঁ হ্যাঁ বলা সং’ এর মতো। বলাই যেত, ‘আপনার ভাইপোর গোটা লোকসভা এলাকায় গ্রাম পঞ্চায়েতে ৪৭ শতাংশ আসনে ভোট হচ্ছে না।’ কিন্তু সেটুকু বলা দন্ত বিগলিত করা লোকেদের পক্ষে সম্ভব নয়। সফরসঙ্গী হলে তো আরও সম্ভব নয়। তাঁদের দন্ত সবসময় বিগলিতই থাকে।
যাই হোক, তিনি জানালেন, বিরোধীরা জিতলেও তারা কাজ করতে পারবে না। তারা তৃণমূলেই চলে আসবে।
আহা, কী গর্বের কথা।
কোনটা গর্বের, আর কোনটা লজ্জার এই সাধারণ বোধবুদ্ধিটুকুও তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। বিরোধী কোনও প্রার্থী জিতলে কাজ করতে পারবে না, তাকে শাসক দলে আসতে হবে। এটা কোনও মুখ্যমন্ত্রী বলতে পারেন! হ্যাঁ, পারেন। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী পারেন। নিজের গালে নিজে থাপ্পড় মারার ক্ষেত্রে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
বিরোধী একজন প্রার্থী জনতার ভোটে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। তিনি তাঁর এলাকার কাজ করতে পারবেন না কেন? কী বোঝাতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী? পুলিশ তাঁর কথা শুনবে না। বিডিও তাঁর কথা শুনবেন না। নির্বাচিত প্রধান বা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তাঁর কথা শুনবেন না, এই তো! এটা একটা রাজ্য প্রশাসনের পক্ষে খুব গর্বের বিষয়! খুব বড়াই করে বলার মতো বিষয়!
বরং, তিনি যদি যথার্থ মুখ্যমন্ত্রী হতেন, তাহলে বলতেন, বিরোধী প্রার্থীও মানুষের দ্বারা নির্বাচিত। তাঁর মতামতেরও গুরুত্ব থাকবে। তাঁর নাহ্য দাবির কথাও পুলিশ, বিডিওকে শুনতে হবে। তাঁর প্রস্তাব প্রধান বা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিকে গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হবে। যদি না শোনেন, যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিন্তু তিনি সে পথ মাড়ালেন না। তিনি বোঝাতে চাইলেন, বিরোধী যদি কেউ জিতেও যান, তাঁর কথা কেউ শুনবে না। বাধ্য হয়ে তাঁকে শাসক দলেই আসতে হবে।
কতখানি নির্লজ্জ হলে এমনটা বলা যায়! আসলে, লোক দেখিয়ে, ঢাক পিটিয়ে প্রশাসনিক মিটিং যাঁরা করতে পারেন, তাঁদের কাছে এটাই প্রত্যাশিত। প্রশাসন কীভাবে চালাতে হয়, সেই প্রাথমিক পাঠটুকুও নেই। শেখার কোনও ইচ্ছেও নেই। কেউ যে শেখাবেন, আশেপাশে এমন লোকও নেই। সেই পারিষদরা তো ‘ধন্য ধন্য’ করতেই ব্যস্ত।
বাম জমানায় তো পঞ্চায়েতের তিন স্তরেই বিরোধী অনেকে জিততেন। তাঁরা পঞ্চায়েত সমিতি চালাতেন, জেলা পরিষদ চালাতেন। শাসক দলের পঞ্চায়েত যতখানি সাহায্য পেত, বিরোধীরাও তাই পেত। তাঁদের তো দল ছেড়ে শাসক দলে নাম লেখাতে হয়নি। শাসক দলের বিধায়কদের জন্য বিধানসভায়, মহাকরণে ছিল অবারিত দ্বার। যে কোনও বিষয় নিয়ে মন্ত্রীদের, অফিসারদের দ্বারস্থ হতে পারতেন। সমস্যার কথা জানাতে পারতেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের সমস্যা বেশি গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করা হয়েছে। তাঁরা নিজেরাই বারবার সেই দাবি করেছেন। সবংয়ের উন্নতি করার জন্য মানস ভুঁইয়াকে কখনও সিপিএম করতে হয়নি। বিরোধী বিধায়ক থাকার পরেও নিজের এলাকার উন্নয়ন করতে কোনও সমস্যা হয়নি। তিনি নিজেই বারবার গর্বের সঙ্গে সেই কথা স্বীকার করেছেন। মালদার উন্নতির জন্য গনিখানকে বা বহরমপুরের উন্নতির জন্য অধীর চৌধুরিকে সিপিএমে আসতে হয়নি।
তাহলে, আজ বিরোধী কেউ জিতলেই কেন বলা হচ্ছে, তিনি কাজ করতে পারবেন না। বিরোধী বিধায়ক তখনই কাজ করতে পারেন না, যখন সরকার অপদার্থ হয়। এটা যে একটা সরকারের কাছে মোটেই গর্বের বিজ্ঞাপন নয়, অনেক বেশি লজ্জার বিজ্ঞাপন, এটুকু যিনি বোঝেন না, তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী!
এই রাজ্যের পিছিয়ে যাওয়া কে ঠেকাবে!