জেলা থেকে একজন মুখপাত্রও পাওয়া গেল না!‌

অজয় কুমার

চায়ের দোকানের তরজা আর টিভির সান্ধ্যকালীন বিতর্ক। মোটামুটি একই জায়গায় চলে যাচ্ছে। এই দুটো মানের মধ্যে যেটুকু ফারাক থাকা দরকার, সেটুকুও থাকছে না। বরং, চায়ের দোকানের তরজায় তবু কিছুটা পড়াশোনা, যুক্তির ছাপ থাকছে। টিভির বিতর্কে সেটুকুও থাকছে না।

এই টিভির টক শো বা বিতর্কতে যাঁরা অংশ নেন, তাঁরা এখন বিধায়ক বা সাংসদদের থেকেও পরিচিত মুখ। আপনি হয়ত টিভি দেখেন না। কিন্তু আপনার মোবাইল বেয়ে সেইসব লিঙ্ক ঠিক এসে যায়। কখনও সেই চ্যানেল ছড়ায়, কখনও কিছু গ্রুপ ছড়ায়, কখনও সেই মুখপাত্র ছড়ান। মোট কথা, আপনি এক–‌দুবার দেখে থাকলে পরের লিঙ্কগুলো ঠিক এসে যায়।

হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া কেউই পড়াশোনা করে আসেন না। যে বিষয়টা নিয়ে বলতে আসেন, সেই বিষয়টা নিয়েও কোনও ধারণাই নেই। যে শেখানে বুলি মুখস্থ আছে, সেটাই আউড়ে যান। যুক্তি দিয়ে খণ্ডন, পাল্টা যুক্তি তুলে ধরা, পুরনো রেফারেন্স প্রাসঙ্গিক টেনে আনা, এগুলো খুব একটা দেখাই যায় না। বামেদের কথায় যদিও কিছুটা পড়াশোনা ও যুক্তির ছাপ পাওয়া যায়, তৃণমূল বা বিজেপির কথা যত কম বলা যায়, ততই ভাল। তাঁরা যেন চিৎকার করতেই আসেন।

কিন্তু এই লেখার বিষয় বামেদের সমালোচনা। যাঁরা আসছেন, তাঁরা ঠিকঠাক তৈরি হয়ে আসছেন তো!‌ অনেকের মধ্যেই অসহিষ্ণুতা চরমে পৌঁছেছে। অন্যের কথা শোনার ধৈর্যই নেই। মাঝপথে চিৎকার করতে থাকেন। আর নিজের যখন বলার সময় আসে, তখনও যুক্তির বদলে অহেতুক চিৎকার দেখা যায়। কাউকে কাউকে দেখে তো হাইপার টেনশনের রোগী বলে মনে হয়।

যেমন এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। যাঁরা আসছেন, প্রায় সবাই কলকাতার মুখ। গ্রাম বাংলার রাজনীতির সঙ্গে এঁদের কোনও সম্পর্কই নেই। এঁরা হয়ত ভাষণ দিতে জেলা বা ব্লক শহরে গিয়েছেন। ভেবে নিয়েছেন, জেলা সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন। এটা অনেকটা ধর্মতলায় এক কাপ চা খেয়ে কলকাতা চিনে ফেলার মতো। একটা ব্লক আসলে কত বড় হয়, একটা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা কত বড় হয়, কোনও ধারণাই নেই।

একদিন বিতর্ক চলতে চলতেই খবর এল, বাঁকুড়া জেলার চারটি পঞ্চায়েত সমিতিতে তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে। এই খবরটার ব্যপ্তি কতটা, বাম প্রতিনিধি বুঝে উঠতেই পারলেন না। মনে হল, যেন চারটে বুথে প্রার্থী দেওয়া যায়নি। আসলে, যাঁদের যাবতীয় ধ্যানধারনাটা কলকাতা কেন্দ্রিক, তাঁদের পক্ষে একটা ব্লক বা পঞ্চায়েত সমিতির ব্যপ্তি বোঝা সম্ভব নয়। শহুরে অ্যাঙ্কারের পক্ষেও সম্ভব নয়, চ্যানেল কর্তৃপক্ষের পক্ষেও সম্ভব নয়, আর বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি হয়ে আসা লোকেদের পক্ষেও সম্ভব নয়।

একটা ব্লকের আয়তন জানেন?‌ গড়পড়তা ৪০০ থেকে ৫০০ বর্গ কিমি। আর গোটা কলকাতার আয়তন কত?‌ ১৮৫ বর্গ কিমি। বিশ্বাস না হলে সবজান্তা গুগলে দেখে নিতে পারেন। অর্থাৎ, একটা ব্লক মানে তিনটে–‌চারটে কলকাতার সমান। একটা ব্লকের ভেতরে তিন–‌চার খানা কলকাতা ঢুকে যাবে। একবার ভেবে দেখুন, কলকাতা পুরসভার একটা ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতে না পারলে কত হইচই হত। গোটা কলকাতা পুরসভায় বিনা লড়াইয়ে জিতলে কী হত, ভেবে দেখুন। হয়ত লন্ডনেও খবর হয়ে যেত। কিন্তু চারটে পঞ্চায়েত সমিতিতে বিরোধীদের প্রার্থী নেই, এটার ব্যপ্তিটা বোঝানোই গেল না। সঞ্চালকের না হয় তেমন দায় নেই। বাম কর্মীর তো দায় ছিল। যুক্তি দিয়ে তো বোঝানো যেত, যে চার পঞ্চায়েত সমিতিতে শুধু তৃণমূলেরই প্রার্থী, সেই চার ব্লক মিলিয়ে গত লোকসভায় তৃণমূল অন্তত এক লাখ ভোটে হেরেছে। এমনকী ২১–‌এর বিধানসভাতেও হেরেছে। কিন্তু এই তথ্য বা এই যুক্তি বাম নেতৃত্ব তুলে ধরতেই পারলেন না। একটা ব্লকের আয়তন কত, দু একজন বাদ দিয়ে বাম প্রতিনিধিরা আদৌ জানেন তো!‌

প্রশ্ন হল, দল থেকে কাদের মুখপাত্র হিসেবে পাঠানো হচ্ছে?‌ জেলার কোনও মুখ নেই যিনি পার্টির অবস্থান তুলে ধরতে পারতেন!‌ অর্থবল, বাহুবল নেই, মানা গেল। ক্ষমতায় না থাকলে মিডিয়া বা প্রশাসনের ওপরও প্রভাব থাকবে না, এটাও স্বাভাবিক। জেতার সম্ভাবনা কম, তাই ভাল মানের প্রার্থী পাওয়া যাবে না, এটাও বোঝা যায়। কিন্তু যুক্তি আর বুদ্ধির দৌড়েও পিছিয়ে থাকতে হবে?‌ এমন দৈনতা কেন আসবে?‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.