উত্তরাধিকারী চিনতে এত ভুল করে গেলেন!‌

সরল বিশ্বাস

দলের শীর্ষনেতা। অথচ, তিনি কোনওদিন সংসদীয় রাজনীতি করেননি। মানে, কখনও লোকসভা বা রাজ্যসভায় সাংসদ হওয়ার চেষ্টা করেননি। কখনও বিধানসভার ভোটে দাঁড়িয়ে বিধায়ক বা মন্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করেননি। নিদেনপক্ষে, কোনও সরকারি কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার চেষ্টা করেননি। বাংলার রাজনীতিতে এমন উদাহরণ আপনি কটা দেখাতে পারবেন?‌ সিপিএমের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রমোদ দাশগুপ্ত, সরোজ মুখার্জি, শৈলেন দাশগুপ্ত, অনিল বিশ্বাস বা বিমান বসুর কথা বলতে পারেন। এঁরা প্রত্যেকেই ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষে ছিলেন। কিন্তু কখনও সংসদীয় রাজনীতির ছায়া মাড়াননি।

এর বাইরে?‌ দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে এমন উদাহরণ না খোঁজাই ভাল। কারণ, সেখানে যাঁর সংসদীয় উচ্চতা যতখানি, দলের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণও সবথেকে বেশি। কিন্তু বাম দলে?‌ ঘুরেফিরে একটাই নাম আসবে, অশোক ঘোষ। প্রায় সাড়ে দশক ধরে তিনি ছিলেন দলের রাজ্য সম্পাদক। নিজের হাতে কত মন্ত্রী, বিধায়ক, সাংসদ তৈরি করেছেন, তার কোনও হিসেব নেই। অথচ, নিজে কখনও সে পথ মাড়াননি। চাইলে, যখন তখন উপমুখ্যমন্ত্রী হতে পারতেন। গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর পেতে পারতেন। যখন তখন সাংসদ হতে পারতেন। কিন্তু সে হাতছানিকে হেলায় উপেক্ষা করেছেন। কখনও বিধানসভা বা মহাকরণেও গেছেন বলে মনে হয় না। সারাজীবন পার্টি অফিসের ছোট্ট একটা ঘরেই কাটিয়ে দিলেন। এমন রাজনৈতিক সন্ন্যাসী বাংলার রাজনীতিতে আর কটা আছে!‌

শেষ প্রায় দুই দশক তিনি চোখে দেখতে পেতেন না। শুধু কণ্ঠস্বরে চিনতেন, কোনটা কে?‌ তারপরেও প্রতিটি ব্যাপারে নিখুঁত আপডেটেড। কে কোথায় কী বলেছেন, কোন বিষয় নিয়ে বিতর্ক চলছে, কোন জল কতদূর গড়াবে, কোন বিতর্কের কীভাবে মীমাংসা করতে হবে, সব ছিল নখদর্পণে। জানতেন, কাকে কতখানি স্নেহ করতে হয়। কাকে উপেক্ষা করতে হয়। কার কথায় কতখানি জল আছে, কে সত্যিকারের সংগঠক, এলাকায় কার গ্রহণযোগ্যতা কতখানি। কখনও স্নেহশীল, কখনও কঠোর, কার ক্ষেত্রে কোন অনুশাসন কতটা শিথিল করা যায়। দলের যে কোনও বিপর্যয়ে মুশকিল আসান সেই তিনিই। ফরওয়ার্ড ব্লক আর অশোক ঘোষ যেন সমার্থক শব্দ হয়ে উঠেছিল।

বছর দুই আগে সেই মানুষটার শতবর্ষ নিঃশব্দে পেরিয়ে গেল। দলের কারও কোনও ভ্রুক্ষেপও ছিল না সেদিকে। পুরনো সিনেমায় দেখা যেত, কেউ মৃত্যু পথযাত্রী হলেই তাঁর সিন্দুকের চাবি হাতানোর দিকে অনেকের নজর থাকত। বুড়ো যাচ্ছে যাক, সিন্দুকে কী আছে, সেটা জানা খুব জরুরি। নিঃশব্দে সিন্দুক খালি করাও জরুরি। তাঁর ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই হয়েছিল। প্রবীণ এই সন্ন্যাসী নিজের জন্য কিছুই রেখে যাননি। এক ছটাক জমিও না। একটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও না। কিন্তু তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন পার্টিটাকে। অন্যের কাছে হাত পেতে, ভিক্ষে করে সেই পার্টির কিছু স্থায়ী সম্পদ তৈরি করেছিলেন। সেই সম্পদের দিকেই চোখ পড়ল রাজনৈতিক শকুনদের। তাঁরাই হয়ে উঠলেন উত্তরাধিকারী। পার্টির একের পর এক সম্পত্তি হয় বিক্রি হল, নয়তো গোপনে লিজ দেওয়া হল। খাল কেটে এমন এক কুমীরকে ডেকে আনা হল, যাঁর প্রধান কাজই হয়ে দাঁড়াল দলের সম্পত্তি একের পর এক বিক্রি করা। কখনও দলের পতাকা বদল করে অন্য দলের সঙ্গে হাত মেলানোর চেষ্টা। কখনও শাসক দলের সঙ্গে রফা করে সাংসদ নয়তো মন্ত্রী হওয়ার চেষ্টা।

এখানেই থেমে যাওয়া নয়। যাঁরা দলের সত্যিকারের সম্পদ, এই আকালেও যাঁরা প্রাণ দিয়ে পার্টিটাকে ভালবাসেন, তাঁদের অপদস্থ করা, হেনস্থা করা, কোনও কিছুই বাদ গেল না। সম্মান বাঁচাতে কেউ বাধ্য হয়েই স্বেচ্ছা নির্বাসনে গেলেন। কাউকে আবার জেলার গোষ্ঠী রাজনীতিতে কোণঠাসা করা হল। তাঁদের বদলে জেলায় জেলায় পেটোয়া বাহিনী তৈরি হল। তালে তাল দিয়ে যাওয়া ‘‌হ্যাঁ হ্যাঁ বলা সঙ’‌ ঠিক জুটেও গেল। গোপনে জেলায় জেলায় সম্পত্তির হাতবদল হয়ে গেল। আলি ইমরানের (‌ভিক্টর) মতো জনপ্রিয় ও লড়াকু নেতা, যিনি ‌দলের মধ্যে থেকেই প্রতিবাদের পতাকা তুলে ধরেছিলেন, কোনও নিয়ম না মেনেই তাঁকে বহিষ্কার করা হল। একদিকে ভিক্টর, যিনি শত প্রলোভনেও শাসক দলে নাম লেখাননি, আরেকদিকে সেই খাল কেটে ডেকে আনা কুমীর, যাঁর একমাত্র লক্ষ্য, দলের সম্পত্তির হাতবদল করা, হাত মেলানোর রফাসূত্র খোঁজা। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, অশোক ঘোষ বেঁচে থাকলে, ভিক্টরকে বহিস্কৃত হয়ে অন্য মঞ্চ খুঁজতে হত না। প্রবীণ মানুষটি হয়ত এই তরুণ তুর্কির হাতেই দিয়ে যেতেন উত্তরাধিকারের ব্যাটন।

কিন্তু তিনি তো চলে গেছেন সেই সাত বছর আগেই। দীর্ঘদিন ছিলেন সংজ্ঞাহীন। তাই তখনকার সময়ে হরির লুঠের বাতাসা যে যেমন পেরেছেন, ভাগ করেছেন। ভাবতে অবাক লাগে, এইসব লোকেরা কিনা অশোক ঘোষের উত্তরাধিকারী!‌ অশোক ঘোষের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সবথেকে বড় ভুল বোধ হয় এটাই। এমন বিচক্ষণ একজন মানুষ, উত্তরাধিকারী চিনতে এত ভুল করে গেলেন!‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.