স্বরূপ গোস্বামী
আমার দিন ফুরালো। সবারই নাকি একটা এক্সপায়ারি ডেট থাকে। ধরে নিন, আমার সেই তারিখ এসে গেছে।
আমার আসার সময়টাও ছিল বড় অদ্ভুত। চলে যাওয়ার সময়টাও তাই। সালটা ২০১৬। নভেম্বরের কোনও এক সন্ধেবেলায় হঠাৎ করে ঘোষণা হল, এখন থেকে পাঁচশো আর হাজার টাকা বাতিল। এগুলির আর কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। দেশজুড়ে যে কী ভয়াবহ অবস্থা। ব্যাঙ্কের সামনে দীর্ঘ লাইন। যার কাছে যত পাঁচশো বা হাজারের নোট আছে, সব জমা দিতে হবে। সরকার বদলে নেওয়ার জন্য দু’মাসের সময় দিয়েছিল। কিন্তু পাবলিক বুঝলে তো! তাকে যেন আজকেই ব্যাঙ্কে ছুটতে হবে। আজকেই সব পাঁচশো–হাজার বদলে ফেলতে হবে। সে কী হুড়োহুড়ি!
কত লোকের কাজ চলে গেল। পরিযায়ী শ্রমিকেরা ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরে এলেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফ থেকে তখন রোজ নিত্যনতুন ঘোষণা। রোজ নিয়ম পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। কোনও নিয়ম শিথিল হচ্ছে, কোনওটা আবার কড়া হচ্ছে। এমনই এক আবহে আমার জন্মবার্তা ঘোষণা হল। বলা হল, হাজার টাকার নোট আর ফিরে আসবে না। পাঁচশোর নোট আসবে, তবে অন্য চেহারায়। আত্মপ্রকাশ হচ্ছে দু’হাজার টাকার।
পাঁচশোর পর একেবারে একধাপে দু’হাজার। তার মানে, আমিই সবথেকে মূল্যবান। আমিই সবথেকে এলিট ক্লাসের। তখন আমাকে পায় কে! আমাকে নিয়ে নিমেশে কত গল্পও ছড়িয়ে গেল। আমার ভেতর নাকি চিপ লাগানো থাকবে। কোন দু’হাজার টাকার নোট কোথায় আছে, নিমেশে বেরিয়ে যাবে। কার ঘরে কটা দু’হাজারের নোট মজুদ আছে, সরকার নাকি ঠিক জানতে পারবে। অর্থাৎ, কালো টাকা গচ্ছিত রাখার দিন শেষ। কত তাবড় তাবড় অর্থনীতিবিদ আমাকে নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় বসে গেলেন। সন্ধের টিভি চ্যানেলজুড়ে আমার জয়জয়কার।
গোলাপি রঙের জামা গায়ে দিয়ে আমার আবির্ভাব। সবে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে ছেপে এসেছে। নতুন বইয়ের যেমন গন্ধ থাকে, নতুন নোটেরও বোধ হয় থাকে। একেবারে কড়কড়ে দু’হাজার। কেউ গন্ধ শুঁকছে। কেউ আমার সঙ্গে সেলফি তুলছে। কেউ আমাকে বালিসের তলায় রেখে ঘুমোতে যাচ্ছে। কেউ আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে। আমাকে নিয়ে যতরকম আদিখ্যেতা করা যায়, কোনওটাই বাকি ছিল না।
কিন্তু সেই মোহ কাটতে সময় লাগল না। এটিএমে গেলেই আমি বেরিয়ে আসছি। এমনকী যে আড়াই হাজার টাকা তুলছে, তাকেও একটা দু’হাজারের নোট গছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দশ হাজার তুলতে গেলে পাঁচটা কড়কড়ে দু’হাজার। দেখতে বেশ লাগে। কিন্তু বাজারে গেলেই সে এক মস্ত বিড়ম্বনা। কোনও দোকানদার নিতে চাইছে না। কেনই বা নেবে! কেউ দেড়শো টাকার জিনিস নিয়ে যদি দু’হাজারের নোট দেয়, দোকানি বাকি সাড়ে আঠারোশো কোত্থেকে দেবে! ফলে, সে দু’হাজার দেখলেই হাতজোড় করে বলছে, দাদা, জিনিস নিতে হবে না। তবু ওই দু’হাজার নিতে পারব না। বেচারি ক্রেতা। সেই বা ছোট নোট পাবে কোথায়! এটিএমে তাকে তো ওই দু’হাজার গছিয়ে দিয়েছে। এই বড় নোট ছোট করার যে কী হ্যাপা, যারা জানে, তারাই জানে।
এভাবেই সম্পদ বদলে গেল আপদে। আরে বাবা, এই দেশটার সবাই তো আর টাটা–বিড়লা বা আম্বানি–আদানি নয়। তারা তো আর লাখ লাখ টাকার লেনদেন করে না। তাদের দিন–আনি, দিন–খাইয়ের রোজ নামচায় এই দু’হাজার এক মস্ত বিড়ম্বনা হয়েই দেখা দিল। হাতে এলে, কতক্ষণে ভাঙিয়ে ছোট নোট করা যায়, সেটাই যেন একমাত্র চিন্তা। এটিএমে গিয়ে লোকে ভুলেও দু’হাজারের বেশি অঙ্ক লিখছে না। কারও তিন হাজার দরকার হলে সে দু’বার করে দেড় হাজার তুলছে। চার হাজার দরকার হলে, দেড়, দেড়, এক–এভাবে তিনবারে ভেঙে নিচ্ছে। মোদ্দা কথা, আমি অচ্ছুৎ, আমাকে ঘরে তোলা যায় না। তার ওপর আমার নকল হতেও সময় লাগল না। ‘মহান’ শিল্পীরা আমাকে হুবহু জাল করে বাজারে ছেড়ে দিল। দোকানিরা পড়ল আরও সমস্যায়। যদি জাল নোট হয়! এই আতঙ্কে আমার ছায়াই মাড়াতে চাইল না।
বলুন তো, এমন অচ্ছুৎ হয়ে কাঁহাতক আর থাকা যায়! বলা হয়েছিল, কালো টাকা রুখতে আমাকে বাজারে আনা হয়েছে। অথচ, যেখানে যতরকমের অনিয়ম, সেখানে আমার উপস্থিতি। যেখানে তল্লাশি হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে, খাটের তলায়, বস্তার ভেতর থরে থরে দু’হাজারের নোট। অবৈধ লেনদেন মানেই যেন আমি। টিভিতে ফলাও করে সেইসব বাজেয়াপ্ত টাকার ছবিও দেখাচ্ছে। অর্থাৎ, যেখানে কালো টাকা, সেখানে আমি। একদিকে, আমজনতার কাছে আমি অচ্ছুৎ, অন্যদিকে কালো টাকার কারবারিদের কাছে আমি দিব্যি ঘাপটি মেরে আছি।
বলুন তো, এমন অচ্ছুৎ হয়ে থাকার জন্য, এমন ‘কালো ধন’ হয়ে থাকার জন্য কি আমার জন্ম হয়েছিল! বলি, আমার কী মানসম্মান বলে কিছু নেই! আমি সবথেকে দামী নোট। অথচ, এমন অসম্মান কি আমার প্রাপ্য ছিল! সরকারও হয়ত সেটা বুঝেছিল। তাই আর নতুন করে ছাপছিল না। এটিএমে দিচ্ছিল না। যা ব্যাঙ্কে ঢুকছিল, আর বেরোচ্ছিল না। বাজার থেকে আস্তে আস্তে ভ্যানিস হয়েই আসছিলাম। এবার সেই মৃত্যুঘণ্টা। যার কাছে যা দু’হাজারের নোট আছে, ব্যাঙ্কে জমা দিন। এবার অবশ্য অনেকটা সময়। ধীরে সুস্থে দিলেই হবে। তাই হুড়োহুড়ি নেই। তাছাড়া, অধিকাংশ লোক আমাকে আগেই ত্যাগ করেছে। তাদের মানি ব্যাগ থেকে, আলমারি থেকে আমি আগেই নির্বাসিত। তাই, তাদের কোনও টেনশনও নেই।
আমার এই মৃত্যু কোনও আকস্মিক মৃত্যু নয়। বলতে পারেন, অনেকদিন ধরেই ভেন্টিলেশনে ছিলাম। মৃত্যুর দিন গুনছিলাম। বিদায়বার্তাটা শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল। আমার বিদায়ে কারও কোনও দুঃখ নেই, কারও কোনও হাহুতাশ নেই, দেশজুড়ে কোথাও কোনও চাঞ্চল্য নেই, জাতীয় রাজনীতিতে তোলপাড় নেই। একেবারে নিঃশব্দ বিদায় বলতে যা বোঝায়, তাই।
সাড়ে ছয় বছরের আয়ু নিয়ে আমি এসেছিলাম। মহাকালের কাছে সাড়ে ছয় বছর কী এমন সময়! সবাই একদিন ভুলেও যাবে। বলতেই পারতাম, ‘আমি রব নিষ্ফলের, হতাশের দলে’। না, এতখানি হতাশ হতে রাজি নই। তাই সেই বিশ্বকবির ভাষাতেই বলি, ‘আকাশেতে আমি রাখি নাই মোর/ উড়িবার ইতিহাস/ তবু উড়েছিনু/ এই মোর উচ্ছ্বাস’।