বিশ্বাসের সিংহাসন থেকে জাস্টিস গাঙ্গুলিকে কে সরাবে!‌

স্বরূপ গোস্বামী

আমরা একই শহরের নাগরিক। কিন্তু কখনও আপনাকে চোখে দেখিনি। মানে, সামনাসামনি দেখিনি। অদূর ভবিষ্যতে দেখা হবে, এমন সম্ভাবনাও প্রায় নেই বললেই চলে।

তবু আপনি আমার অচেনা নন। বেশ চেনা চেনাই মনে হয়। আরও একধাপ এগিয়ে বললে, বেশ আপনজনই মনে হয়। শুধু আমার কেন, এভাবেই গত একবছরে আপনি লক্ষ লক্ষ মানুষের আপনজন হয়ে উঠেছেন।

এমনিতেই হাইকোর্টের বিচারপতিদের সঙ্গে গড়পড়তা সাধারণ মানুষের একটা দূরত্ব থেকেই যায়। তাঁরা কোনও সভাসমিতিতে যান না। তাঁদের কাছেও অন্যরা যেতে পারেন না। টিভি বা কাগজে তাঁদের কথা কতটুকুই বা বেরোয়!‌ সত্যি বলছি, এক বছর আগেও অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলে কোনও বিচারপতির নামই শুনিনি।

আপনার আগেও কলকাতা হাইকোর্টে দিকপাল সব বিচারপতিরা এসেছেন। একের পর এক রায় দিয়ে গেছেন। কখনও সরকারকে কড়া তিরষ্কারও করে গেছেন। তখন তাঁদের নিয়ে এক–‌দু দিন হইচই হয়েছে। নিমেশে, সেসব থেমেও গেছে। কারণ, তাঁরাও মাঝে মাঝে ফোঁস করেছেন। আবার শীতঘুমে চলে গেছেন। যথারীতি মামলা ‘‌তারিখ পে তারিখ’‌ নিয়ম মেনে হিমঘরে চলে গেছে।

কিন্তু আপনি লোকটা একেবারেই অন্য ধাঁচের। সিবিআই তদন্ত দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না। লেগে রইলেন। তদন্তের গতিপ্রকৃতি কোনদিকে এগোচ্ছে, নজর রাখলেন। মাঝে মাঝেই সিবিআই–‌কে ধমক দিলেন। কড়া তিরষ্কার করলেন। বুঝিয়ে দিলেন, আসল পান্ডাকে ধরার কোনও সদিচ্ছাই সিবিআইয়ের নেই। বুঝিয়ে দিলেন, মামলা অনন্তকাল ধরে চলবে, তা হতে পারে না। দ্রুত তদন্ত শেষ করতে হবে। দ্রুত বিচারপ্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। এক কলমের খোঁচায় শয়ে শয়ে চাকরি নস্যাৎ করে দিলেন।

মৌচাকে ঢিল মেরেছেন মশাই। কেন সারদা, নারদা তদন্তে সিবিআই অশ্বডিম্ব প্রসব করল, আপনি বেশ ভালই জানেন। কেন এক্ষেত্রেও সিবিআই একটা সময়ের পর গিয়ে থমকে যাচ্ছে, সেটাও আপনার থেকে ভাল কে জানে!‌ তারা কয়েকটা ভুঁইফোড় এজেন্টকে ধরে, সেই ধুরন্ধর এজেন্টরা হাওয়ায় এক–‌দুজন মহিলার নাম ভাসিয়ে দেয়। ব্যাস, ওই নিয়েই মেতে থাকে মূলস্রোত মিডিয়া। আসল মাথাকে আড়ালে রাখতে যা যা করা দরকার, সিবিআই সেটাই করে চলেছে।

আপনিও সবকিছুই বুঝতে পারছেন। কিন্তু চেয়ারে বসে তো আর সবটা বলা যায় না। যেটুকু বলা যায়, সেটুকু হজম করাই কারও কারও কাছে বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ওপর তলায় তাঁরা অনেকটাই ম্যানেজ করে ফেলেছে। সিবিআই–‌কেও শীতঘুমে পাঠিয়ে দিতে সময় লাগবে না। কিন্তু যত নষ্টের গোড়া আপনি। আপনার জন্যই এইসব ধেড়ে ইঁদুরেরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারছে না।

যেভাবেই হোক, আপনাকে সরাতে হবে। এখনই পৃথিবী থেকে সরানো মুশকিল। চেষ্টা হবে অন্য কোনও হাইকোর্টে বদলি করার। তারই প্রথম ধাপ হল, দুটো মামলা আপনার বেঞ্চ থেকে সরিয়ে নেওয়া। যে সুপ্রিম কোর্ট ডিএ মামলা মাসের পর মাস ঝুলিয়ে রাখে, সেই সুপ্রিম কোর্ট এক্ষেত্রে কত তৎপর!‌ আপনাকে সরিয়ে দিতে পনেরো দিনও লাগল না। নিশ্চিত থাকুন, এইসব বিচারপতিরা অবসরের পরই ঠিক প্রোমোশনাল পোস্টিং পেয়ে যাবেন। হয় রাজ্যসভার সদস্য হবেন, নয়তো রাজ্যপাল হবেন, নিদেনপক্ষে কোনও না কোনও কমিশনের মাথায় বসবেন।

আপনি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বলে কি এত গাত্রদাহ!‌ মোটেই না। সেটা তো অজুহাতমাত্র। সেই সাক্ষাৎকারে আপনি একটা মারাত্মক কথা বলেছেন, যেটা নিয়ে কোনও আলোচনা হচ্ছে না। আপনি বলেছেন, অবসরের পর আপনি কোনও পোস্টিং নেবেন না। এতবড় একটা কথা তো এর আগে কোনও বিচারপতিকে বলতে শুনিনি। তাই রামমন্দির, কাশ্মীর, নোটবন্দি সংক্রান্ত রায় দিতে গিয়ে যাঁরা শাসকের হুকুম তামিল করেছেন, তাঁদের কেউ রাজ্যপাল, কেউ সাংসদ হয়ে গেছেন। এখন যাঁরা একের পর এক মামলায় রাজ্য সরকারকে স্বস্তি দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছেন, কেন্দ্রের সবুজ সংকেত ছাড়া তাঁরা এইসব সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে পারতেন!‌ কিন্তু এই সহজ অঙ্কগুলো এই দেশের লোকেরা সহজে বোঝে না।

কিন্তু রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষ এই সত্যিটুকু বোঝেন, এই একজন মানুষ আছেন, যিনি এখনও লড়াইটা লড়ে যাচ্ছেন। যিনি এত সহজে লড়াই থেকে পিছিয়ে যাবেন না। যিনি বিক্রি হয়ে যাবেন না। এমনকী, তৃণমূলের লোকেরাও অন্তত পিসি বা ভাইপোর থেকে আপনাকে বেশি বিশ্বাস করে।

তাই, আপনার হাত থেকে মামলা সরে যাচ্ছে শুনলে ধর্মতলায় ধর্নায় বসা চাকরি প্রার্থীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। পাড়ার রকে আড্ডা দেওয়া ছেলেরাও কোথাও একটা মুষড়ে পড়ে। কেউ ফেসবুকের দেওয়াল ভরিয়ে দেয়। কেউ একা একা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হ্যাঁ, জাস্টিস গাঙ্গুলি, এত এত মানুষের আস্থা আপনি অর্জন করেছেন।

এরপরেও নানা টালবাহানা চলবে। আপনাকে অপদস্থ করার নানা চেষ্টা বজায় থাকবে। হয়ত মামলার গতি শ্লথ হয়ে আসবে। হয়ত সুপ্রিম কোর্টের কেউ কেউ এইসব আপাদমস্তক দুর্নীতিতে ডুবে থাকা ধেড়ে ইঁদুরদের ত্রাতা হয়ে উঠবেন। সময়ের নিয়মে আপনি হয়ত অবসরের বৃত্তে পৌঁছে যাবেন। কিন্তু তারপরেও উজ্জ্বল হয়ে থেকে যাবে এই নামটা।

হ্যাঁ, এই নামটাকে বাঙালি বড্ড ভাল বেসে ফেলেছে। বড্ড বিশ্বাস করে ফেলেছে। সেই ভালবাসা ও বিশ্বাসের সিংহাসন থেকে আপনাকে সরানোর ক্ষমতা ওই কীর্তিমানদের নেই, এমনকী সুপ্রিম কোর্টেরও নেই।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.