(আজ অমল দত্তর জন্মদিন। এমন দিনে তাঁকে নিয়ে একটি পুরনো লেখা তুলে ধরা হল বেঙ্গল টাইমসের পাঠকদের জন্য।)
ময়ূখ নস্কর
অমল দত্তকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানাতে বড্ড দেরি হয়ে গেল। বড্ড দেরি।
রবীন্দ্র সদনে তাঁকে মালা দিলেন রাজ্য সরকারের প্রধান। নিমতলায় তাঁর সম্মানে গর্জে উঠল পুলিশ বাহিনির বন্দুক। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, তাঁর নামে রাস্তা হবে, স্টেডিয়াম হবে। কিন্তু এই মালা, গান স্যালুট, নামকরণে অমল দত্তর আর কি কিছুই যায় আসে ?
মৃত্যুর পর তাঁকে সম্মান জানিয়ে রাজ্য সরকার উপযুক্ত কাজই করেছে, কিন্তু জীবিত অবস্থায় কেন্দ্র, রাজ্য, এই সরকার, ওই সরকার, আই এফ এ, এ আই এফ এফ কেউ কি সম্মান জানিয়েছে ? না জানায়নি।
আমরা অমল দত্তর গুণমুগ্ধরা রাগে ফুঁসে উঠি তাঁর প্রতি এই অবিচার দেখে। কিন্তু ভেবে দেখুন, এই অবিচারেও অমল দত্তর কিছুই যায় আসে না। সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ কোন সম্মান দিতে পারত? দ্রোণাচার্য পুরস্কার তাই তো ? কিন্তু এই অমল দত্ত কি দ্রোণাচার্য নামের উপযুক্ত? না তিনি তা নন। তিনি দ্রোণাচার্যের থেকেও উপরে।
দ্রোণাচার্য কে ছিলেন বলুন তো? পাণ্ডব এবং কৌরবদের অস্ত্রগুরু। অর্জুন, ভীম, দুর্যোধন, এঁরা সকলেই তাঁর ছাত্র। এঁরা সকলেই মহাবীর। কিন্তু বলুন তো, হস্তিনাপুরের রাজপরিবারের সন্তানদের মহাবীর বানানোয় কী এমন কৃতিত্ব আছে ? তাঁরা রাজপুত্র, ক্ষত্রিয়, বংশ পরম্পরায় বীর।
সত্যিকারের মহাগুরু হলে, দ্রোণাচার্য রাজপরিবারের বাইরের মানুষদের মহাবীর অস্ত্র শিক্ষা দিতেন। কিন্তু দ্রোণাচার্য তা করেননি। বরং আদিবাসী একলব্য, সুতপুত্র কর্ণকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। দ্রোণাচার্যের এক ছেলে ছিল অশ্বত্থামা। তাঁকে তিনি অর্জুনের সমকক্ষ করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। পারেননি। আরও একটা ভয়ঙ্কর অমিলের উদাহরণ দেওয়া যাক। পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, দ্রোণ ছিলেন রাজাদের ধামাধরা। অন্যায় করছে জেনেও দুর্যোধনের পাশে ছিল। কিন্তু অমল দত্ত কাউকে কখনও রেয়াত করেননি। তাই কর্তাদের সুনজরে কখনই তিনি থাকেননি। বরং যে কয়েকজন কোচ কর্তাদের অপ্রিয়, সেই তালিকায় সামনের সারিতেই থাকবে তাঁর নাম।
এখানেই দ্রোণাচার্যের সঙ্গে অমল দত্তর অমিল। তিনি শুধু রাজপরিবারে মানে বড় ক্লাবে কোচিং করাননি। ছোট ক্লাবে গিয়েও দাপটের সঙ্গে কাজ করেছেন। শুধু বড় বড় প্লেয়ারদের নিয়ে টিম গড়েননি। অসংখ্য একলব্য, কর্ণ তাঁর প্রশিক্ষণে মহাবীর হয়ে উঠেছেন। তাঁর কোনও অশ্বত্থামা, মানে পেয়ারের প্লেয়ার ছিল না। টিমের সঙ্গে খাপ খাবে না বলে, ব্যারেটো-বাইচুংকেও ‘চাই না’ বলে দিয়েছিলেন।
দ্রোণাচার্য চাইতেন যে কোনও ভাবে যুদ্ধে জিততে। তাই তিনি, চক্রব্যূহ গড়ে অভিমন্যুকে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু অমল দত্ত এমন চক্রব্যূহ গড়তেন না। সারা ম্যাচ জুড়ে গোল বাঁচাব। কোনও রকমে একটা গোল করতে পারলেই
নিজের গোলের সামনে পাঁচিল তুলে দেব, এমন কোচ তিনি ছিলেন না। ডায়মন্ড সিস্টেম নিয়ে ৪ গোল খাওয়ার পরেও আক্রমণাত্মক ফুটবল ছাড়েননি। সুন্দর ফুটবলকে ছাড়েননি।
তাই সাফল্যের বিচারে তিনি অনেকের পিছনে, কিন্তু জনপ্রিয়তায় সবার ওপরে। জনতার প্রিয়, তাই তিনি কর্তাদের অপ্রিয়। তিনি অন্যদের থেকে এগিয়ে, তাই সবাই তাঁকে দেরিতে বুঝেছে। তাই তিনি দ্রোণাচার্য নন। তাই তিনি সবার উপরে। দ্রোণাচার্যেরও উপরে। ভাগ্যিস তিনি দ্রোণাচার্য পাননি। পেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অন্যান্য দ্রোণাচার্য, অন্যান্য মহাগুরুদের সঙ্গে তাঁকে এক করে ফেলত।