এমন এক কিংবদন্তি মানুষের শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে একেবারে নিঃশব্দেই। বছর তিন আগের কথা। সেবার চারিদিকে করোনার আতঙ্ক। টিভি খুললেই করোনা। কাগজে খুললেও করোনা। রাস্তা শুনশান। তার মাঝেও যেটুকু লোক সমাগম, সেখানেও যেন করোনা ছাড়া কিছুই ছিল না। এমন আবহে কে সত্যজিৎ রায়! তাঁকে আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম।
পরের বছর, অর্থাৎ ২০২১ এর ২ মে ছিল ভোটের ফল প্রকাশের দিন। কারা আসবে ক্ষমতায়? ফের তৃণমূল? নাকি চোরাস্রোতে ঢুকে পড়ছে গেরুয়া হাওয়া! এই আলোচনাতেই আগের কয়েকদিন মশগুল ছিল বাঙালি। ২ মে সকাল থেকেই বাঙালি টিভির সামনে, ভোটের রেজাল্ট দেখায় ব্যস্ত। সকাল থেকেই বিশেষজ্ঞরা সেজেগুজে বসে গিয়েছিলেন ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণে। দুপুর থেকেই আবিরের বন্যা, জয়ের উল্লাস। ওই উল্লাসের মাঝেও কোথায় সত্যজিৎ!
পরপর দুটো বছর আমরা কিন্তু বেশ নির্লিপ্তই ছিলাম এই কিংবদন্তিকে নিয়ে। শতবর্ষ–টর্ষ চুকে যেতে আগের বছর থেকে কিছুটা যেন মনে পড়েছে তাঁর কথা। টুকটাক দু–একটা বিশেষ সংখ্যা বেরোচ্ছে। টিভির পর্দায় আবার তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণ। কেউ বা ধামাকা দিতে সৌরভ গাঙ্গুলিকে নিয়ে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে। যথারীতি সময়ের নিয়মে পেরিয়ে গেল আরও একটা বছর। কোন খাতে বইবে আমাদের সত্যজিৎ চর্চা? সরকারি উদ্যোগ ঠিক কেমন থাকবে? এরই মাঝে গত একবছরে একটা ঘটনা ঘটে গেছে। সত্যজিৎ রায়ের জীবন নির্ভর ছবি ‘অপরাজিত’। যেখানে পথের পাঁচালী তৈরির ইতিবৃত্ত, আড়ালে থাকা নানা ঘটনা সুন্দরভাবে তুলে এনেছেন পরিচালক অনীক দত্ত। দেশে–বিদেশে সমাদৃত। অথচ, খোদ নন্দনে সেই ছবি জায়গা পায়নি। কারণ! ওই যে পরিচালকের নাম অনীক দত্ত। তাঁর ছবি নন্দনে চলবে? নৈব নৈব চ। বিষয় যদি সত্যজিৎ হয়, তবুও না। বাংলার শিল্পী মহলের বড় একটা অংশ যথারীতি নীরব থেকে যান। হ্যাঁ, ওইদিন কাগজে ঢাউস বিজ্ঞাপন বেরোবে। কোনও একজনের অনুপ্রেরণায় সত্যজিৎ স্মরণ হচ্ছে, বুঝিয়ে দেওয়া হবে। পরেরদিন মাল্যদানের ছবি বেরোবে। সেই শ্রদ্ধা কতটা আন্তরিক, প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ, নন্দন গেলে বোঝাই যাবে না, এর উদ্বোধক সত্যজিৎ রায়। সেখানে বিরাট ফলকে উদ্বোধক অন্য কেউ।
পয়লা মে–র জন্য পরেরদিন কাগজ বন্ধ থাকে। অর্থাৎ, সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনে কাগজ বেরোয় না। ফলে, বিশেষ ক্রোড়পত্র, স্মৃতিচারণের পর্ব সেরে রাখতে হয় দু–একদিন আগেই। কী হবে, কিছুটা আন্দাজ করাই যায়। কেউ ফেসবুকে ছবি সাঁটালেন। কেউ হোয়াটস অ্যাপ স্টেটাসে সত্যজিৎ রায়ের ছবি দিয়ে তাঁকে ধন্য করলেন। ওইটুকুই। হাতের সামনে ইউটিউব। ঢালাও নেট পরিষেবা। কিন্তু কজন দেখবেন সত্যজিতের অন্তত একটা ছবি? বইয়ের তাকের ধুলো সরিয়ে কজন পেড়ে নেবেন সত্যজিতের কোনও বই!
তবু ভাল। অন্তত করোনা ভীতি বা ভোট উল্লাসের মাঝে তিনি হারিয়ে যাননি। এই বিস্মৃতির আবহে এটুকুই যেন বড় প্রাপ্তি। বেঙ্গল টাইমসের সামর্থ্য সীমিত। নতুন–পুরনো লেখার ডালি মিলিয়ে তার মতো করে সত্যজিতের প্রতি রইল শ্রদ্ধার্ঘ্য। পড়ুন, পড়ান।
স্বরূপ গোস্বামী
সম্পাদক,
বেঙ্গল টাইমস
*****
https://bengaltimes.in/wp-content/uploads/2023/05/1683370290442_satyajit-issue-2023.pdf