অজয় নন্দী
গতবছর আইপিএলের কথা মনে করুন। সেবার করোনার কারণে জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়নি। তার বদলে হয়েছিল জমকালো সমাপ্তি অনুষ্ঠান। মধ্যমণি কে? সৌরভ গাঙ্গুলি। জয়ী দলের হাতে ট্রফিও তুলে দিয়েছিলেন বাংলার মহারাজ।
আগের দু’বারের আইপিএলেও তাই। মরুদেশেও মধ্যমণি সেই সৌরভই। মাত্র একবছরেই চিত্রনাট্যে কত পরিবর্তন। এখন তিনি বোর্ডে ব্রাত্য। তিনি ছাড়া সবাই রয়ে গেছেন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। আর তিনি! ফিরে এলেন ডাগআউটে। কোট–টাই থেকে আবার সেই ক্রিকেটের জার্সিতে।
জীবনের নানা বাঁকে কার জন্য কোন চিত্রনাট্য লেখা আছে, সত্যিই বোঝা মুশকিল। আমেদাবাদের জমকালো অনুষ্ঠানে তাঁর থাকার কথা ছিল। কিন্তু তিনি কিনা কোটলার মাঠে দিল্লি ক্যাপিটালসের ডাগআউটে। দল একের পর এক ম্যাচ হেরে চলেছে। বাঁকা বাঁকা মন্তব্য ভেসে আসছে। তার মাঝেও তিনি বারবার সতীর্থদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। বারবার বলে চলেছেন, যা হয়েছে, ভুলে যাও। নতুন করে শুরু করো। পাঁচটা ম্যাচ হেরেছ তো কী হয়েছে! সামনে নটা ম্যাচ বাকি! কে বলতে পারে, তোমরা সেই নটা ম্যাচে জিতবে না!
যা হয়েছে, ভুলে যাও। কথাটা বলা সহজ। কিন্তু কাজে করে দেখানো ততটাই কঠিন। কিন্তু তিনি সৌরভ গাঙ্গুলি। তিনি সব ভুলে নতুন করে শুরু করতে পারেন। তাঁর জায়গায় অন্য কেউ হলে এতদিনে গোসা ঘরে খিল দিয়ে বসতেন। একবার বোর্ড সভাপতি হওয়ার পর আবার একটা ফ্র্যাঞ্চাইজির কার্যত কোচিংয়ের দায়িত্ব নেওয়া! এ অনেকটা প্রধানমন্ত্রী থাকার পর একটা ছোট রাজ্যের রাজ্যপাল হওয়ার মতোই।
অন্য কেউ হলে এমন চ্যালেঞ্জ নিতেন! নিশ্চিতভাবেই এড়িয়ে যেতেন। আমি কোথায় ছিলাম, আজ কোথায় আছি! এটা ভেবে সারাক্ষণ হতাশায় ভুগতেন। কিন্তু তিনি জানেন, এটাই জীবন। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে। সেই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করতে হবে। এটা কি শুধু ক্রিকেটীয় দিক? আমাদের জীবনেও তো এমনটা আখছার ঘরে। কথায় কথায় আমরা নিজেদের বঞ্চিত ভেবে ফেলি। একটু অসম্মানিত হলেই পালিয়ে বাঁচার পথ খুঁজি।
কিন্তু পালিয়ে কি সত্যিই বাঁচা যায়! পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। সেটাই আসল লড়াই। একদিন আমি বোর্ড সভাপতি ছিলাম ঠিকই। আজ নেই। তাই বলে কি চুপ করে ঘরে বসে থাকব? আমার যেটা করার, আমি ঠিকই করে যাব। তাঁকে কি কম অস্বস্তি তাড়া করছে? বিরাট কোহলি তাঁর সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন না। ইনস্টাগ্রামে আনফলো করে দিচ্ছেন। এই উপেক্ষা হজম করতে হচ্ছে। যে ধারাভাষ্যকাররা তাঁকে তোল্লাই দিয়ে যেতেন, তাঁরাও সুযোগ বুঝে বাঁকা মন্তব্যে ব্যস্ত। যে কর্তারা তাঁর আশেপাশে থাকার জন্য হুড়োহুড়ি করতেন, ছবি তোলার জন্য ঠেলাঠেলি করতেন, আজ তাঁরা এড়িয়ে যাচ্ছেন। যদি এক ফ্রেমে ছবি উঠে যায়, অনেক বিপদ আছে।
তিনি কি এমন পরিস্থিতির কথা জানতেন না! বেশ জানতেন। এটুকু বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টি তো তাঁর আছে। এরপরেও দায়িত্বটা নিয়েছেন। অনেকেই বলতে পারেন, টাকার জন্য। কী এমন টাকা পাবেন দিল্লি ক্যাপিটালস থেকে। কয়েকটা বিজ্ঞাপন করলে বা কয়েকটা অনুষ্ঠানে ফিতে কাটলেই এর থেকে ঢের টাকা উপার্জন করতে পারেন। তাহলে, অন্তত বারবার এই অস্বস্তিকর মুহূর্তগুলো তৈরি হত না।
এখানেই আর দশজনের সঙ্গে তাঁর ফারাক। ঠুনকো ইগো নিয়ে থাকা নয়। বরং অন্য পিচেও বুক চিতিয়ে ব্যাট করে যাওয়া। কোনও চ্যালেঞ্জকেই ছোট করে না নেওয়া। আইপিএলে সৌরভের দল কত নম্বরে থাকবে, জানা নেই। হয়ত সবার শেষে। কিন্তু দিনের শেষে চ্যাম্পিয়নও কিন্তু তিনিই। বোর্ড সভাপতি থাকার পরেও আবার মাঠে ফিরে আসার এমন নজির ভারত তো দূরের কথা, বিশ্ব ক্রিকেটেও নেই। কোনওদিন হবে, এমন সম্ভাবনাও কম।