বাংলাস্ফিয়ারের নদী বইতে থাকুক

মিডিয়া সমাচার

হরিশ মুখার্জি

দেখতে দেখতে এক বছর হয়ে গেল। একটা ইউটিউব চ্যানেলেরও এক বছর পথ চলা মানে খুব সহজ ব্যাপার নয়। গত কয়েক বছরে বেশ কিছু ইউটিউব চ্যানেল এল। আবার নিঃশব্দে হারিয়েও গেল। শুরুতে অনেকে ভেবে নেন, ইউটিউব চ্যানেল মানেই বোধ হয় প্রচুর রেভিনিউ। কিন্তু এই মোহটা ভাঙতে সময় লাগে না। ঠিকঠাক কনটেন্ট দেওয়া, ধারাবাহিকভাবে লেগে থাকা, প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ঠিকঠাক প্রোমোট করা। এই তিনের মেলবন্ধন না থাকলেই একসময় উৎসাহ হারিয়ে যায়। মাঝপথেই পথ চলা থমকে যায়।

এখানে যে ইউটিউব চ্যানেল নিয়ে আলোচনা, তা হল বাংলাস্ফিয়ার। বিরাট কিছু সাবস্ক্রাইবার নেই। এখনও দশ হাজার অতিক্রম করেনি। পরিসংখ্যান বলছে, মোট ভিডিওর সংখ্যা ২২০। কোনওটির ভিউয়ার এক হাজার, কোনওটির দেড় হাজার। কোনওটির তিন হাজার। এই হল পরিসংখ্যান। কিন্তু সেই কোনকাল আগে নেভিল কার্ডাস বলেছিলেন, স্কোরবোর্ড হল একটি গাধা। সে আসলে কিছুই বলে না। ইউটিউবের ক্ষেত্রেও কথাটা খাটে। সাবস্ক্রাইবার দিয়ে বা ভিউয়ার দিয়ে কতটুকুই বা বোঝা যায়। লাইক বা কমেন্ট দেখেও আসলে কিছুই বোঝা যায় না। বুঝতে হয় সেই নদীতে নেমে, বুঝতে হয় আরও গভীরে গিয়ে।

চটকদারি জিনিসে প্রাথমিক ভিউয়ার অনেক বেশি। কিন্তু একসময় চালাকিটা ধরা পড়ে যায়। এই চ্যানেলের দর্শক–‌শ্রোতাদের ক্লাস একটু অন্যরকম। তাঁদের খিদেটাও অন্যরকমের। এক–‌দুটো এপিসোড হয়ত অনেকে দেখেছেন। যাঁদের ভাল লেগেছে, তাঁরা টিকে আছেন। যাঁদের ভাল লাগেনি, তাঁরা হারিয়েও গেছেন। আসলে, আর দশজন স্বঘোষিত সবজান্তার থেকে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ফারাক যে অনেকটাই। এত বছরের অভিজ্ঞতা, এত গুণীজনের সান্নিধ্য, বিস্তর পড়াশোনা, ইতিহাসকে এত কাছ থেকে দেখা, সেইসঙ্গে দুরন্ত বিশ্লেষণ। এর একটা আলাদা মূল্য তো আছেই। আবার এটাও ঠিক, এগুলো সবার ভাল লাগবে না। যাঁরা সেই ইতিহাস জানেন না, যাঁদের বিশ্লেষণ শোনার মতো মনন বা ধৈর্য নেই, তাঁদের ভাল না লাগারই কথা।

 

এখানে অহেতুক খেউড় নেই। গলা ফুলিয়ে চিৎকার নেই। অকারণ চাঞ্চল্য তৈরি করার মতো হেডিং নেই। এ এক শান্ত নদীর মতো। আপনি বুঝে সুঝেই স্নান করতে নামুন। ঢেউয়ের তরঙ্গ হয়ত পাবেন না। তবে নদীর স্নিগ্ধতা পাবেন। এমন কিছু জানতে পারবেন, যা আপনি আগে কোথাও শোনেননি। এমন কিছু বিশ্লেষণ পাবেন, যা শুনে মনে হবে, আগে তো এভাবে ভাবিনি। আটের দশক বা নয়ের দশকে দিল্লির রাজনীতির চেহারাটা কেমন ছিল, সেই ছবিটা সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। স্বভাবতই সুমনবাবুর মেলামেশা যাঁদের সঙ্গে ছিল, তাঁদের কথা, স্মৃতিচারণ ঘুরেফিরে আসে। সেটাই তো স্বাভাবিক। কখনও জ্যোতি বসুর কথা, কখনও প্রণব মুখার্জির কথা, কখনও সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় বা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির কথা। আবার কখনও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অনিল বিশ্বাস, সোমনাথ চ্যাটার্জিদের কথাও। এইসব মানুষেরা নিজেদের কথা মুখ ফুটে জাহির করতেন না। ফলে, অনেকটাই অজানা থেকে গেছে। যাঁরা এঁদের কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছেন, তাঁদের মুখ থেকে যেটুকু জানা যায়। বিশ্লেষণের সঙ্গে আপনি একমত হতেও পারেন, নাও হতে পারেন। কিন্তু শুনতে বা জানতে আপত্তি কোথায়?‌

এবার যাঁরা শুধু মমতা, মোদি ছাড়া কিছু বোঝেন না, তাঁদের ভাল নাও লাগতে পারে। যাঁদের রাজনীতি চর্চার দৌড় ওই ফেসবুকের কয়েকটা লঘু পোস্ট বা মিম, তাঁদের ভাল লাগার কথাও নয়। ভাল জিনিস গ্রহণ করতে গেলে একটা আধার লাগে। রবিশঙ্করের সেতার বা চৌরাশিয়ার বাঁশি কি যাকে তাকে শোনানো যায়!‌ তেমনই কিছু পড়াশোনা না থাকলে এই চ্যানেল আপনার ভাল লাগবে না। কোথাও কোনও ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা কি নেই?‌ ১)‌ অনেকসময় আলোচনার পরিসরটা বেশ বড় হয়ে যাচ্ছে। চল্লিশ মিনিট, পয়তাল্লিশ মিনিটও হয়ে যাচ্ছে। ফলে, কিছু অতিকথন এসে যাচ্ছে। পুনরাবৃত্তিও এসে যাচ্ছে। অনেকের হয়ত এতখানি ধৈর্য না থাকতেও পারে। ২)‌ বয়সের একটা প্রভাবও কাজ করছে। একসময় যেমন বাগ্মী ছিলেন, সেই ধার কিছুটা কমবে, সেটাই স্বাভাবিক। ৩)‌ কিঞ্চিত আত্মপ্রচারও এসে যাচ্ছে। তবে তিনি তো নিজের অভিজ্ঞতা বলতে বসেছেন। তাই একটু আধটু আসাটা অস্বাভাবিকও নয়। কোথাও কোথায় হয়ত একটু মাত্রা ছাড়াচ্ছে। ৪)‌ তিনি যে খুব পেশাদারি ভঙ্গিতে করছেন, এমন নয়। করছেন কিছুটা আপন খেয়ালে। ফলে, অনেক সময় ধারাবাহিকতা থাকছে না। মাঝে মাঝেই বলেন, ‘‌রইল ঝোলা, চলল ভোলা’‌ করে কোনদিন পালিয়ে যাব।

তবে এরপরও বলতে হবে, রাজনীতি নিয়ে যাঁদের আগ্রহ আছে, যাঁরা আরও কিছু শিখতে চান, জানতে চান, তাঁরা এই চ্যানেলটি শুনতে পারেন। সব অনুষ্ঠান না হোক, যেগুলো ভাল লাগবে, সেগুলি শুনতে পারেন। দিনের শেষে আপনি কিন্তু সমৃদ্ধই হবেন। একটা মানুষের সারাজীবন ধরে অর্জিত অভিজ্ঞতার কিছুটা ভাগ যদি আপনি পান, মন্দ কী!‌ পরিশেষে, সুমনবাবুকেও অনুরোধ, দু একটা বিরূপ মন্তব্য দেখে বিচলিত হবেন না। এমন বেনোজল সর্বত্রই থাকে। তাঁদের পেছনে বেশি সময় বা মনযোগ কোনওটাই নষ্ট করার দরকার নেই। কিছু অর্বাচীন যেমন থাকবে, তেমনই মননশীল শ্রোতারও অভাব নেই। বাংলাস্ফিয়ারের এই নদী আপন খেয়ালে, তার নিজের মতো করে বয়ে চলুক। যার ইচ্ছে, সে নদীতে নামবে। কেউ না হয় দূর থেকেই দেখবে।

(‌মিডিয়া সমাচার। বেঙ্গল টাইমসের একটি জনপ্রিয় বিভাগ। এখানে থাকে মিডিয়া জগতের নানা অজানা কথা, বিশ্লেষণ। তা কোনও কাগজ নিয়ে হতে পারে, কোনও চ্যানেল নিয়ে হতে পারে। এমনকী ইদানীং মূলস্রোত মিডিয়ার সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দেওয়া সোশ্যাল মিডিয়াও হতে পারে। পাঠকেরও আমন্ত্রণ। মিডিয়ার নানা দিক নিয়ে তাঁরাও পাঠাতে পারেন নিজেদের বিশ্লেষণ। তুলে ধরতে পারেন কোনও ইউটিউব চ্যানেল বা ফেসবুক গ্রুপকে।)

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.