মাঝে মাঝেই কথাটা শোনা যায়, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে...। যে অন্যায় করছে, আর যে অন্যায় সহ্য করছে, দুজনকে কী সুন্দর এক সারিতে এনে ফেলা হয়।
ঠিক তেমনি, ইদানীং কিছু নীতি জ্যাঠামশাই বলে চলেছেন, ‘ঘুস দিয়ে চাকরি কেনাটাও সমান অপরাধ। এদের চাকরি যাওয়াই উচিত।’
এই ব্যাখ্যা শুনলে কেন জানি না, খুব রাগই হচ্ছে। একজন ঘুস নিচ্ছে, আর একজনকে বাধ্য হয়ে ঘুস দিতে হচ্ছে, দুজনকে একসঙ্গে দাগিয়ে দেওয়া যায়? দুজনের অপরাধ কখনও সমান হতে পারে!
আদালতের রায়ে শাস্তি কার হচ্ছে? যিনি অন্যায়ভাবে চাকরি পেয়েছেন। তাঁর ওপর একসঙ্গে কত আঘাত নেমে আসছে। ১) চাকরি চলে যাচ্ছে। ২) এতদিনের বেতন ফেরত দেওয়ার নির্দেশ। ৩) সামাজিক সম্মানহানি। ৪) যে টাকা দিয়ে চাকরি হয়েছিল, সেটাও আর ফেরত পাওয়া যাবে না।
মনে হচ্ছে, তাঁরাই যেন আসল আসামী। অথচ, যিনি নিচ্ছেন, আসল ভাগ যাদের কাছে পৌঁছচ্ছে, তাঁরা দিব্যি আড়ালেই থেকে যাচ্ছেন। কোনও তদন্ত তাঁদের ছুঁতে পারছে না। মিডিয়া সব জেনেও তাঁদের নাম বলার সাহস দেখাচ্ছে না। উল্টে তাঁদের নীতিকথা সম্বলিত ভাষণ দিনভর প্রচার করে যাচ্ছে। এরপরেও তাঁরা কী অবলীলায় ‘জিরো টলারেন্স’এর গল্প শুনিয়ে যাচ্ছেন। সেসব দিয়ে ব্রেকিং নিউজ হচ্ছে। সেইসব নাটের গুরুদের হয়ে স্তাবকতা করতে সন্ধেবেলায় টিভিতে ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীও জুটে যাচ্ছে। সবাই জানে, রাজা নগ্ন, কিন্তু বলার লোক নেই।
উল্টে আবার বাম জমানার কথা টেনে আনা হচ্ছে। তখন নাকি বিস্তর অনিয়ম হয়েছিল। দুর্নীতি হয়েছিল। একটা কথা স্বীকার করে নেওয়াই ভাল, বিস্তর না হোক, অল্পবিস্তর তো হয়েছিল। হয়েছিল বলেই সেটাকে আটকাতে এসএসসি চালু করা হয়েছিল। বলা ভাল, এসএসসি চালু করতে হয়েছিল। এই সহজ সত্যিটা স্বীকার করে নিলে সেটা অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য হত। কিন্তু বাম নেতৃত্বও সমানে বলে চলেছেন, প্রমাণ করে দেখাক। মানুষের চারপাশে নিজের চোখে দেখা সত্যিকে গলার জোরে ওড়াতে গেলে অন্য দাবিগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যায়। এটা তো ঘটনা, বিরাট কিছু টাকা পয়সার লেনদেন না হলেও কোথাও স্থানীয় ছেলে, কোথাও পার্টির ছেলে, কোথাও স্কুল কমিটির কারও আত্মীয় একটু হলেও বাড়তি সুবিধা পেয়েছেন। এই খুচরো ভাল লাগা, মন্দ লাগা সব আমলেই থাকবে।
তবে এটাও ঠিক, এসএসসি চালু হওয়ার পর এই প্রবণতা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছিল। পোস্টিংয়ের ক্ষেত্রে হয়ত টুকটাক প্রভাব কাজ করেছে। কিন্তু নিয়োগের ক্ষেত্রে যে স্বচ্ছতা ছিল, তা অতিবড় নিন্দুকও অন্তত আড়ালে স্বীকার করবেন। সেই সময়ের কাগজ খুলুন। বামেদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ পাবেন। ভিত্তিহীন, আষাড়ে অভিযোগও বিস্তর। কিন্তু এসএসসি তালিকায় দুর্নীতি হচ্ছে, এমন অভিযোগ বিরোধীদের দিক থেকেও পাবেন না। না বিধানসভার প্রসিডিংসে, না টিভির আলোচনায়, না বিরোধীদের ডেপুটেশনে।
শহরে থেকে চিত্রটা বোঝা যাবে না। একটু গ্রাম বা মফস্বলে গেলে ছবিটা কিছুটা পরিষ্কার হবে। যাঁদের স্কুলে চাকরি হয়েছে, তাঁদের দিকে একবার তাকান। ১) না আছে রাজনৈতিক পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড। ২) না আছে টাকা দেওয়ার সামর্থ্য। এলাকায় তাঁরা ভাল ছাত্র হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। আবার উল্টোদিকে যাঁদের হয়নি, সেদিকটাও দেখুন। ১) প্রভাবশালী ঘরের ছেলে। ২) টাকা পয়সা দেওয়ার ক্ষমতা। এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি।
এসব দেখেশুনেই মানুষের মনে একটা বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল, নিয়োগটা সোজা পথেই হচ্ছে। তাই টাকা নিয়ে নেতাদের পেছনে বা দালালদের পেছনে ছুটতে হয়নি। কারণ, যাঁর মেধা ছিল, তিনি জানতেন, টাকা ছাড়াই হবে। আবার যাঁদের মেধা নেই, নম্বর নেই, তাঁরাও জানতেন, টাকা দিলেও হবে না। অনুরূপভাবে নেতারা বা দালালরাও বিলক্ষণ জানতেন, এখানে কিছুই করার নেই। তাই ইচ্ছে থাকলেও তাঁরা টাকা নেওয়ার সাহস পাননি।
কিন্তু গত দশ বছরে ছবিটা আমূল বদলে গেল। যাঁর মেধা আছে, সেও বুঝল, টাকা না থাকলে হবে না। আবার যাঁর মেধা নেই, সেও বুঝল, টাকা থাকলে, দালাল ধরলে একবার চেষ্টা করা যেতেই পারে। প্রশ্ন হল, এই সিস্টেমটা ডালপালা মেলল কী করে? সর্বোচ স্তরের মদত না থাকলে এই দালাল চক্র এভাবে গজিয়ে উঠতে পারত না। সর্বোচ্চ মহল মানে কী? পর্ষদ সভাপতি? এসএসসি চেয়ারম্যান? ধুর, এঁরা নেহাতই চুনোপুঁটি। এমনকী, তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীকেও সেই চুনোপুঁটির তালিকাতেই রাখা যায়। তাহলে তাঁর থেকেও বড় মাথা কে? সুমনের গানের ভাষাতেই বলতে হয়, প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা।
জানা উত্তর নিয়ে বেশি চর্চা না হওয়াই ভাল। সিবিআই বরং খুঁজে চলুন। তদন্তকে বিপথে নিয়ে যাক। একের পর এক নতুন নতুন দালালের নাম সামনে এনে মানুষকে বিভ্রান্ত করুক। মিডিয়া বরং সেইসব দালাল আর তাদের বান্ধবীদের নিয়ে মেতে থাক।
আসল কথা হল, সিস্টেম। যে সিস্টেমে টাকা না দিলে কিছুই হবে না। প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে এটাই দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রশাসন অসহায়। আদালত ও মিডিয়া ছিল দার্শনিক প্রশ্রয়দাতার ভূমিকায়। সত্যিই যদি আদালত, পুলিশ, মিডিয়া সক্রিয় থাকত, তাহলে এই দুর্বৃত্তদের সাহস এই পর্যায়ে পৌঁছত? যাঁরা টাকা দিয়েছেন, শুধু তাঁদের ভিলেন করলে কোনও সমাধান হবে না। কেন দিনের পর দিন এই অরাজকতা চলেছে, কেন এখনও চলছে, সেটা আগে ভাবুন। যাঁদের চাকরি যাচ্ছে, তাঁরা সফট টার্গেট। তাই আদালত এক কলমের খোঁচায় তাঁদের চাকরি খেয়ে নিচ্ছে, পর্ষদ তাদের তালিকা ঝুলিয়ে দিচ্ছে, মিডিয়া তাঁদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এত কাণ্ডের পরেও যাঁরা আড়ালে থেকে গেলেন, তাঁরা একের পর এক প্রমাণ লোপাট করে চলেছেন। ভাষণ দিয়ে চলেছেন।
আম নাগরিকের হয়ত বিরাট কিছু করার নেই। তাঁরা সত্যিই অসহায়। কিন্তু একটু রাগ, একটু ঘৃণা তো করতে পারি। প্রশাসনের রিমোট হয়ত তাঁদের হাতে। কিন্তু আপনার টিভির রিমোট তো আপনার হাতে। যখন এই দুর্বৃত্তরা ভাষণ দিচ্ছেন, সভা করছেন, তখন অন্তত চ্যানেলটা তো ঘুরিয়ে দিতে পারেন। সিনেমা, সিরিয়াল, খেলা, কার্টুন যেখানে খুশি চলে যান। ওই দুর্বৃত্তদের দেখতে চাই না, চ্যানেলকে অন্তত এই বার্তাটুকু তো দিতে পারেন। এর জন্য নিশ্চয় বাড়িতে পুলিশ কড়া নাড়বে না।
আর হ্যাঁ, যাঁদের চাকরি গেল বা যাচ্ছে, তাঁদের নিয়ে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ আপাতত মুলতুবি রাখুন। আপনার রাগ, ঘৃণা তাঁদের ওপর বর্ষিত হলে আসল নাটের গুরুরা আড়ালেই থেকে যাবেন।