দিলীপ ঘোষের ব্যাটন এখন কুণাল ঘোষের হাতে

সরল বিশ্বাস

বছর খানেক আগের কথা। কাকভোরে মিডিয়াকে ছুটতে হত হয় সেন্ট্রাল পার্কে, নয়তো ইকো পার্কে। কারণ, দিলীপ ঘোষ সেখানে হাঁটবেন। হাঁটার পর প্রাতরাশের মতো কিছু বাণী বিতরণ করবেন। তিনি হয়ত আগের রাতেই ভেবে রাখতেন, পরদিন সকালে কী বলবেন। প্রশ্ন আসুক না আসুক, উত্তর রেডি। হাওয়ায় দু’‌চার কথা ভাসিয়ে দিতেন। ব্যাস, সকাল থেকে শুরু হয়ে গেল ক্রিয়া–‌প্রতিক্রিয়া। মোটামুটি বিকেল পর্যন্ত এই ‘‌প্রতিক্রিয়া’‌ পর্ব চলত। বেলার দিকে, দুপুরের দিকে, তখনও তৃণমূল মুখপাত্রের কাছে ফোন যেত। কখনও ফোন যেত কোনও সিপিএম নেতার কাছে। অনেক সময় সন্ধেবেলায় টিভির চণ্ডীমণ্ডপেও (‌টক শো)‌ তাই নিয়েই আলোচনা হত। অর্থাৎ, সারাদিন বাঙালি কী নিয়ে চর্চা করবে, সেটা কাকভোরে দিলীপ ঘোষই ঠিক করে দিতেন।

দিলীপ ঘোষ এখনও আগের মতোই ভোরে ওঠেন। আগের মতোই কেন্দ্রীয় বাহিনির জওয়ান পরিবেষ্টিত হয়ে হাঁটতে বেরোন। কিন্তু মুশকিলটা হল, এখন তিনি আর রাজ্য সভাপতি নন। তাই, কাকভোরে মিডিয়া সেভাবে ছুটে যায় না। সকালবেলার সেন্ট্রাল পার্ক আর দৈনন্দিন বিট থাকে না।

এখন সেই দায়িত্বটা নিয়ে ফেলেছেন কুণাল ঘোষ। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ সাংবাদিক। পলিটিক্যাল বিটে গত তিরিশ বছরে এত এক্সক্লুসিভ খবর খুব কম সাংবাদিকই করেছেন। যেমন নির্মেদ লেখনি, তেমনই প্রখর নিউজসেন্স। যতই দলের মুখপাত্র হোন, সেই নিউজসেন্সে এতটুকু মরচে পড়েনি। কত নন ইস্যুকে তাঁর কলমের জোরে জোরদার ইস্যু করে তুলেছেন। জানেন, কোন খাবার কীভাবে পরিবেশন করতে হয়। এত ব্যস্ততার মাঝেও পড়াশোনার চর্চাটা হারিয়ে ফেলেননি। জানেন, কোন খাবারে কখন কোন মশলা মেশাতে হয়।

তিনি অবশ্য ভোরে হাঁটতে বেরোন কিনা জানা নেই। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে দিলীপ ঘোষ যে ভূমিকাটা পালন করে এসেছেন, এখন কুণাল ঘোষ ঠিক সেটাই পালন করছেন। তবে, এর জন্য তাঁকে ভোরেও উঠতে হচ্ছে না। আর কয়েক মাইল হাঁটতেও হচ্ছে না। সাত সকালে একটা ফেসবুক পোস্ট বা টুইট ছেড়ে দিচ্ছেন। ব্যাস, হামলে পড়ছে মিডিয়া। এমনিতেই সকাল দিকে খবরের ঘাটতি থাকে। আগেরদিনের বাসি খবর কাঁহাতক আর বারবার রিপিট করা যায়!‌ সকালের ব্রেকফাস্ট মেনুতে নতুন কিছু তো চাই। বিচক্ষণ সাংবাদিক কুণাল ঘোষ যেন সেই মেনুর জোগান দিয়ে যাচ্ছেন। জানেন, কোনদিন বাজারে কোনটা ছাড়তে হবে। কোনদিন মমতা বা অভিষেকের সভা আছে। সেদিন ছাড়লে চলবে না। কোনদিন ফাঁকা বাজার। কোনদিন কোনটা ছাড়লে সন্ধে পর্যন্ত সেটা নিয়েই বাঙালি মেতে থাকবে। টিভির পর্দা বেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় চর্চা শুরু হবে। অফিস থেকে চায়ের দোকান, তর্কে উত্তাল হবে। আগে তাঁর একেকটা প্রতিবেদন এভাবেই ঝড় তুলত। এখন ছোট্ট একেকটা ফেসবুক পোস্ট হয়ত তার থেকেও বেশি ঝড় তোলে। কোনওদিন হাওয়ায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন সুজন চক্রবর্তীর স্ত্রীর চাকরি বৃত্তান্ত নিয়ে। কোনওদিন শতরূপ ঘোষের গাড়ি নিয়ে। কোনওদিন আবার নয়ের দশকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া কোনও অধ্যাপিকাকে নিয়ে। একটা বিষয় থিতিয়ে গেলেই বাজারে ছেড়ে দিচ্ছেন আরও একটা। সারবত্তা থাকুক না থাকুক, চর্চা চলছেই। ফাঁদে পা দিয়ে ফেলছেন বামেরাও। তাঁরাও সারাদিন সব কাজ ভুলে কুণাল ঘোষের মুণ্ডপাত করতেই ব্যস্ত থাকছেন। কেউ টিভিতে, কেউ ফেসবুকে।

সমর্থন যেমন আছে, ট্রোলিংও কম নেই। কবে মুখ্যমন্ত্রী নিয়ে কী বলতেন, কবে পুলিশ প্রিজন ভ্যানে থাপ্পড় মারত, সেইসব কথা রোজ ট্রোলিংয়ে উঠে আসে। ‘‌চোর’‌, ‘‌চিটিংবাজ’ এসব কথাও উঠে আসে।‌ কুণাল কি রেগে যান?‌ মনে হয় না। তাঁকে নিয়ে সারাদিন চর্চা চলছে, এটা ভেবে বরং বরং, কিছুটা মজাই পান।

আরও একটা কারণে হয়ত মজা পান। কথায় আছে, ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। কুণাল ঘোষ একটি দলের মুখপাত্র হলেও আখেরে একজন সাংবাদিক। আপাদমস্তক সাংবাদিক। ‘‌প্রাক্তন সাংসদ’‌ এই তকমার থেকেও নিজেকে সফল সাংবাদিক ভাবতেই বেশি গর্ববোধ করেন। একজন সাংবাদিকের আনন্দ কীসে?‌ আমি এমন একটা খবর করব, পরের দিন সকালে হইচই পড়ে যাবে। অন্য সব মিডিয়াকে পরেরদিন সেটার ফলোআপ করতে হবে। চাইলেও অন্যরা উপেক্ষা করতে পারবে না। নয়ের দশকে কুণাল ঘোষ এমনটা বারেবারেই করে দেখিয়েছেন। এখনও করে চলেছেন। ইলেকট্রনিক মিডিয়া দিনভর সেটা নিয়েই চর্চা করে চলেছে। পরের দিন প্রিন্ট মিডিয়াতেও তারই প্রতিফলন। আসল ইস্যু কত সুন্দর আড়ালে চলে যাচ্ছে। হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া পোস্ট নিয়ে সবাই দিনভর কত সুন্দর মেতে থাকছে।

মুখপাত্রের কাজ কী?‌ দলের কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই কাজেও নতুন একটা ডায়মেনশান এনেছেন কুণাল। দলের দিকে উঠে আসা অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলো অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। সেই কাজে পুরোপুরিই সফল। বামেরাও যেন বুঝে উঠতে পারছেন না তাঁরা কী স্ট্যান্ড নেবেন। মিডিয়া বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছে। কিছু না কিছু বলতেই হচ্ছে। শতরূপ তো দু’‌ঘণ্টার মধ্যে প্রেস কনফারেন্স ডেকে ফেললেন। যাবতীয় ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট, চেকের জেরক্স দেখিয়ে নিজের হয়ে সাফাই দিলেন। কখনও মেজাজ হারিয়ে দু–‌একটা বেহিসেবি কথাও বলে ফেললেন। অমনি, দুদিন পর উকিলের নোটিশ পাঠিয়ে আবার ভেসে উঠলেন কুণাল ঘোষ। অর্থাৎ, ইস্যু থামছে না। মিডিয়ার খাদ্যে বিরাম নেই। গুরুত্ব দেবেন নাকি উপেক্ষা করবেন, সেই সিদ্ধান্তে এখনও আসা গেল না।

মুখ্যমন্ত্রী ভোরে ওঠেন, এমন ‘‌অভিযোগ’‌ নেই। তাঁর কর্মকাণ্ড শুরু হয় বেলার দিকে। তা প্রসারিত মধ্যরাত পর্যন্ত। কিন্তু সকাল দিকের স্পেসটা এতদিন খালিই ছিল। ২৪ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেল। সারাদিন নতুন নতুন খোরাক চাই। কে জোগাবে?‌ কখনও এক–‌দুটো দুর্ঘটনা। কখনও ভোরের দিকে কোনও সেলিব্রিটির মৃত্যু। এছাড়া আর তেমন খাদ্য কই?‌ মিডিয়ার দুঃখ বুঝেছিলেন দিলীপ ঘোষ। এখন বুঝছেন কুণাল ঘোষ। এক ঘোষের ব্যাটন এখন অন্য ঘোষের হাতে।

কুণাল ঘোষের আসল অনুপ্রেরণা তাহলে কে?‌ মমতা ব্যানার্জি?‌ মোটেই না। অন্তত এই ক্ষেত্রে তিনি দিলীপ ঘোষের ব্যাটনটাই হাতে তুলে নিয়েছেন। দিলীপ ঘোষ অন্তত এটুকু ভেবে মুচকি হাসতেই পারেন।

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.