‌রাহুলের থেকেও বড় বড় সব পাপ্পু সংসদ আলো করে আছেন

রক্তিম মিত্র

রাহুল গান্ধী কি দারুণ জনপ্রিয়?‌
এমনটা মোটেই বলা যাবে না!‌ গান্ধী পরিবারের উত্তরাধিকার আছে। কংগ্রেস নেতারা ইচ্ছেয় হোক, অনিচ্ছেয় হোক, তাঁকে মেনে চলেন। এই টুকুই। বিরাট জনপ্রিয় হলে তাঁর জনসভায় ঢল নেমে যেত। বিরাট জনপ্রিয় হলে আমেথিতে এভাবে হারতে হত না। বিরাট জনপ্রিয় হলে কেরলে বিকল্প আসন খুঁজতে হত না।

রাহুল গান্ধী কি দারুণ বক্তা?‌
মোটেই না। একেবারেই সাদামাটা বক্তা। কংগ্রেসের বেঞ্চেই তাঁর থেকে অন্তত একডজন ভাল বক্তা আছেন। যাঁদের বক্তৃতায় পড়াশোনা থাকে, যুক্তি থাকে, মাটির গন্ধ থাকে। রাহুল যতই বলুন, তিনি সংসদে মুখ খুললে মোদি সরকার বিপদে পড়ে যাবে, আসলে মোটেই তা নয়। তিনি যা বলেন, সবাই সেটা জানেন। রাহুলের বক্তব্যে নতুন কোনও মাত্রা যোগ হয় না। ‌

রাহুল গান্ধী কি দারুণ বিচক্ষণ?
এমনটাও বলা যাবে না। অনেকেই তাঁকে বলতে পার্ট টাইম পলিটিসিয়ান। মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যেতেন। কোথায় যেতেন, দলের লোকেরাও জানত না। নানা রাজ্যে নানা সমস্যা, গোষ্ঠীকোন্দল। ঠিকমতো সামাল দিতে পারেননি। তাই, অনেকেই দল ছেড়ে নাম লিখিয়েছেন অন্য শিবিরে। পুরনো–‌নতুনের বিভাজনটাও রয়েই গেছে। কোথায় বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, কোথায় তেমন গুরুত্ব না দিলেও চলবে, এই হিসেবে মাঝেমাঝেই গন্ডগোল করে বসেন।

‌চাইলে, রাহুল গান্ধী সম্পর্কে আরও গোটায় কুড়ি যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর অক্ষমতাকে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু তারপরও দিনের শেষে কোথাও একটা এগিয়ে রাখতে হয়। তাঁর মধ্যে এমন কিছু আছে, যা অন্যদের মধ্যে নেই।

গত সাত–‌আট বছর ধরে তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে ‘‌পাপ্পু’‌ শব্দটা। এই শব্দটা কে ব্যবহার করেছেন?‌ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। দেশের জনসভায় বলেই ক্ষান্ত থাকেননি। বিদেশে প্রবাসীদের মাঝেও আখছার এইসব শব্দ ব্যবহার করেছেন। আর প্রধানমন্ত্রী বলছেন, মানে বাকিদেরও বলতে হবে। নেমে পড়ল আইটি সেল। নেমে পড়ল লেজুড় মিডিয়া। কর্তাকে তুষ্ট করতেই হবে। অতএব, লেগে পড়ো রাহুলের পেছনে। লেগে পড়ো নেহরুর পেছনে। কিন্তু সত্যি করে বলুন তো, ২০০৪ থেকে ১৪, এই দশ বছরে তাঁকে খুব একটা অপরিণত মনে হয়েছিল?‌

২০০৪ এ সোনিয়া প্রধানমন্ত্রী হলেন না। তখনই রাহুলকে হয়ত মসনদে বসানো যেত না। কিন্তু যে কোনও দপ্তরের মন্ত্রী করা যেত। কোথাও কোনও আপত্তি উঠত না। কিন্তু রাহুল সে পথ মাড়ালেন না। অন্য তরুণদের তুলে এনে মন্ত্রীসভায় জায়গা দিলেন। কিন্তু নিজে মন্ত্রী হওয়ার কোনও চেষ্টাই করলেন না। চেষ্টা করতেও হত না। কারও কাছে মুখ ফুটে কিছু চাইতেও হত না। ‘‌আমার আপত্তি নেই’‌ এইটুকু বললেই যথেষ্ট ছিল।

এবার ২০০৯। এবার আরও বেশি আসন নিয়ে ফিরে এল কংগ্রেস। উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্য থেকেও তুলে আনলেন ২১ আসন। স্বয়ং মনমোহন সিং নিজে চাইলেন সরে যেতে। রাহুলকে জায়গা ছেড়ে দিতে। সামনের পাঁচ বছর মসৃণভাবে সরকার চালানোর সুযোগ। কিন্তু রাহুল এবারও সাড়া দিলেন না। মনমোহন চাইলেন, নিদেনপক্ষে কোনও একটা গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর নিন। কিন্তু রাহুল তাও নিলেন না। নিজেকে মন্ত্রীসভার বাইরেই রাখলেন।

অনেকে বলতেই পারেন, তিনি মন্ত্রী হয়ে কী করবেন?‌ বকলমে তিনিই তো সরকার চালাচ্ছেন, কে কী মন্ত্রী হবেন, ঠিক করছেন। পুরোটা না হলেও আংশিক সত্যি। কিন্তু তারপরেও নিজেকে দূরে রাখা বেশ কঠিন কাজ। বুকের পাটা লাগে। কজনের থাকে?‌

এবার উল্টোদিকের কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০১৪ লোকসভা ভোটের সময় বিজেপির জাতীয় সভাপতি কে ছিলেন?‌ রাজনাথ সিং। অর্থাৎ, মোদিকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরা হবে, এই সিদ্ধান্ত রাজনাথ সিংয়ের নেওয়া। দলের সভাপতি মানে, তাঁকে কার্যত কিংমেকারই বলা যায়। কিন্তু যেই মোদি প্রধানমন্ত্রী হলেন, অমনি সুট সুট করে মন্ত্রীসভায় ঢুকে পড়লেন। গুরুত্ব পাচ্ছেন না। তাও থাকতে হবে। একসময় রাজনাথ এলে মোদি উঠে দাঁড়াতেন। আজ মোদি এলে রাজনাথ উঠে দাঁড়ান। সেই মন্ত্রীসভায় ঢুকে পড়লেন আরেক প্রাক্তন জাতীয় সভাপতি নীতিন গড়করি।

রাজনাথ মন্ত্রীত্বে যাবেন বলে সভাপতি পদ ছাড়লেন। কে এলেন অমিত শাহ। পাঁচ বছরও গেল না। তার মধ্যেই মনে হল, এমপি না হলে জীবন বৃথা। প্রথমে এলেন রাজ্যসভায়। ২০১৯ এ মনে হল, এবার লোকসভায় দাঁড়াতে হবে, মন্ত্রী হতেই হবে। দাঁড়িয়ে গেলেন। মন্ত্রী হয়েও গেলেন। আরেক জাতীয় সভাপতি পাঁচ বছরের মধ্যেই ঢুকে পড়লেন মন্ত্রীসভায়। তাঁরাও তো কিংমেকার হয়ে থাকতে পারতেন। মন্ত্রীসভার বাইরে থাকলেও যথেষ্ট প্রভাবশালীই থাকতে পারতেন। কিন্তু পারলেন কি মন্ত্রীসভা থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখতে?‌

এঁদের পাশে যখন রাহুল গান্ধীকে দেখেন, তখন কাকে বেশি করে পাপ্পু মনে হয়?‌ যে বুকের পাটা রাহুল দেখিয়েছিলেন, সেটা তো রাজনাথ বা অমিত শাহ দেখাতে পারলেন না।

এমনকী কংগ্রেস যখন বিরোধী আসনে, মল্লিকার্জুন খাড়গে বা অধীর চৌধুরিকে লোকসভার দলনেতা না করে নিজেই হতে পারতেন। দুঃসময়ে এটাই বা কে ছাড়ে!‌ কিন্তু রাহুল এখানেও নিজেকে দূরে সরিয়েই রাখলেন। পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি বা এইসব কোনও কমিটির চেয়ারম্যানের পদ থেকেও নিজেকে সরিয়েই রাখলেন। নির্বাচনে বিপর্যয়ের দায় নিয়ে সভাপতি পদও ছেড়েই দিলেন। অনেকেই বলেছিলেন, দর বাড়াচ্ছেন। দেখা গেল, সত্যিই তিনি ছাড়তে আগ্রহী। ছাড়তে চেয়েছিলেন। সত্যি সত্যিই ছেড়ে দেখালেন। এটাও কিন্তু কম চ্যালেঞ্জ ছিল না।

একটা ভারত জোড়ো যাত্রায় কি কংগ্রেসের পালে বিরাট জোয়ার চলে আসত?‌ ভোটবাক্সে কি এগুলো সত্যিই কোনও প্রভাব ফেলে?‌ তাহলে তো গুজরাটেও প্রভাব পড়ত। তারপরেও বিজেপি কেন যে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না!‌ তাঁর সাংসদ পদ বাতিলের এমন উদ্যোগ নেওয়া খুব জরুরি ছিল?‌ বিজেপি নেতৃত্ব বলতেই পারেন, এটা আদালতের রায়। আইন আইনের পথে চলেছে। কিন্তু এটা কি নিছক আদালতের রায়?‌ আইনকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একজন রামমন্দির নির্মাণের রায় দিলেন। কেউ রাফাল চুক্তির যাবতীয় অনিয়মের অভিযোগকে খারিজ করে দিলেন। কেউ ৩৭০ ধারা বাতিলের সিদ্ধান্তকে বৈধ আখ্যা দিলেন। কেউ আবার নোটবাতিলের যাবতীয় অনিয়মকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনলেন না। অবসর নেওয়ার এক মাস যেতে না যেতেই তাঁদের কেউ হয়ে গেলেন রাজ্যসভার সাংসদ, কেউ হয়ে গেলেন রাজ্যপাল। এর থেকেই বোঝা যায় আইন কেমন আইনের পথে চলছে। যাঁরা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিকে এমন নির্লজ্জভাবে ‘‌খরিদ’‌ করতে পারেন, তাঁরা সুরাটের নিম্ন আদালতকে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করবেন না?‌ এটা বিশ্বাসযোগ্য ?‌ আদালতের রায় নিয়ে এমন প্রশ্ন ওঠা কাম্য নয়। কিন্তু কী আর করা যাবে?‌ সরকার আর আদালত নিজেরাই নিজেদেরকে এমন নির্লজ্জ জায়গায় নামিয়ে এনেছে।

তাছাড়া, রাহুল কী এমন আপত্তিকর কথা বলেছেন?‌ তাঁর থেকে অনেক নোঙরা ইঙ্গিত কি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী করেননি?‌ কখনও সোনিয়াকে উদ্দেশ্য করে, কখনও মনমোহন সিংকে উদ্দেশ্য করে মোদি যে ভাষায় কথা বলেছেন, সেই তুলনায় রাহুলের মন্তব্য নেহাতই নিরামিশ। তুলনাতেই আসে না। কখনও সংসদে, কখনও জনসভায়, আবার কখনও বিদেশে গিয়েও নিজের নিম্নরুচির পরিচয় দিয়ে এসেছেন। রাহুল চাইলেও সেই জায়গায় নামতে পারবেন না। কারণ, তাঁর পেটে কিছুটা হলেও বিদ্যে আছে। তাঁর অনেক সহপাঠী পাওয়া যাবে, শিক্ষক পাওয়া যাবে। কোথায়, কবে পাশ করেছেন, তার নথি পাওয়া যাবে। যার একটাও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে না।

নিম্ন আদালতের রায় বেরোতে না বেরোতেই লোকসভা এক কলমের খোঁচায় সাংসদ পদ খারিজ করে দিল। সত্যিই, আইনের প্রতি কতই না নিষ্ঠাবান। এখানেই শেষ নয়, সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেওয়া হয়ে গেল। এমন অন্তত শতাধিক সাংসদ আছেন, যাঁরা বহুকাল আগে প্রাক্তন হয়ে গেলেও বছরের পর বছর বাংলো আঁকড়ে রেখেছেন। সেই তালিকায় বিজেপিরও অনেকেই আছেন। হঠাৎ, রাহুল গান্ধীর বাংলো খালি করার এত তৎপরতা?‌ আসলে, সর্বোচ্চ মহল থেকে যখন নোঙরামির প্রদর্শনী চলে, তখন অসভ্যতাও সীমার মধ্যে আটকে থাকে না। প্রধানমন্ত্রীর সবুজ সঙ্কেত ছাড়া এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস স্পিকারের ছিল?‌

সাত বছর ধরে সংসদের এথিক্স কমিটির একটা সভাও ডাকা গেল না। স্পিকারের লজ্জা হয় না?‌ দলত্যাগ বিরোধী আইনে অভিযুক্ত সাংসদদের দু’‌বছর ধরে শুনানির জন্য পর্যন্ত ডাকা হল না। তখন স্পিকার লজ্জিত হন না?‌ সত্যিই এই সংসদ রাহুলদের মতো ভদ্রলোকেদের জায়গা নয়।

রাহুলকে অনেক পাপ্পু বলা হয়েছে। এবার বোঝা যাচ্ছে, তাঁর থেকে অনেক বড় বড় পাপ্পুর দল সংসদ আলো করে আছেন। ‌‌‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.