এমন একটা লাইব্রেরি হারিয়ে যাবে না তো!‌ ‌

স্বরূপ গোস্বামী

সময়টা ১৯৭৮। একদিন তিনি গিয়েছিলেন ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। গিয়ে দেখলেন, ডাঁই করে এক জায়গায় জড়ো করা আছে কিছু ছোটখাটো পত্রিকা। এগুলির কী হবে?‌ খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, এইসব পত্রিকা রাখার জায়গা নেই। ন্যাশনাল লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ এগুলিকে রাখতে আগ্রহীও নন। অতএব, এগুলির কোনও ভবিষ্যৎ নেই। এগুলি ফেলেই দেওয়া হবে।

তখন তিনি সদ্য তরুণ। সবে কলেজের গন্ডি পেরিয়েছেন। নিজেদের উদ্যোগে পত্রিকাও বের করছেন। তাই জানেন, একটা লিটল ম্যাগাজিনের পেছনে কত লড়াই, কত পরিশ্রম, কত স্বপ্ন জড়িয়ে থাকে। সেইসব পত্রিকার সম্পাদকরা নিজেদের পত্রিকাগুলিকে পাঠিয়েছিলেন ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। যদি সংরক্ষিত থাকে!‌ যদি কোনও গবেষকের কোনও কাজে লাগে!‌ যদি কোনও গুণীজনের নজরে পড়ে!‌ কিন্তু এগুলি কিনা ডাস্টবিনে চলে যাবে!‌

সেদিনের সেই তরুণ ঠিক করলেন, এই পত্রিকাগুলিকে এভাবে বাতিল হতে দেবেন না। নিয়ে এলেন নিজের বাড়িতে। ঠিক করলেন নিজেই তৈরি করবেন একটা লাইব্রেরি। নাম দিলেন কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে শুরু হল পথচলা। এবার নিজেই শুরু করলেন লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ। বিভিন্ন দোকান থেকে কোনওটা কিনলেন। কোনওটার গ্রাহক হলেন। কোনওটা বিভিন্ন বন্ধু মারফত আনিয়ে নিলেন। আবার কোনও কোনও সম্পাদক ততদিনে জেনে গেছেন, ট্যামার লেনে এই ম্যাগাজিনগুলি পরম যত্নে সংগ্রহ করে রাখা হয়। তখন তাঁরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে পাঠাতে লাগলেন তাঁদের পত্রিকা।

এভাবেই সংগ্রহ ক্রমশ বাড়তে লাগল। হাতে আসতে লাগল দুষ্প্রাপ্য সব বই ও পত্রিকা। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেলেন এই লাইব্রেরির সঙ্গে। সন্দীপ দত্ত নামটা হয়ে উঠল লিটল ম্যাগাজিনের দুনিয়ায় খুব পরিচিত একটা নাম। দেশ–‌বিদেশের গবেষকরা কী করে যে সন্ধান পেয়ে যান!‌ ছুটে আসেন ট্যামার লেনের এই ছোট্ট লাইব্রেরিতে।

এত এত লাইব্রেরি থাকতে তাঁর লাইব্রেরিতে কেন আসতেন?‌ ১)‌ এখানে এলে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রকাশিত দুষ্প্রাপ্য বই পাওয়া যাবে। যা আর অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। ২)‌ বড় লাইব্রেরি মানে বড় বাজেটের বাণিজ্যিক বই। তাতে সবার খিদে নাও মিটতে পারে। ৩)‌ সন্দীপ দত্ত নিজে একজন চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া। কোন বিষয়টা কোন বইয়ে পাওয়া যাবে, তিনি ঠিক খুঁজে বের করে দেবেন। এই সুবিধা অন্য লাইব্রেরিতে পাওয়া যাবে?‌ ৪)‌ ধরা যাক, আপনি ভাদু বা টুসু গান নিয়ে কিছু খুঁজছেন। সন্দীপ দত্তকে একবার বললেই হল। তিনি আপনার হাতের সামনে কুড়ি রকমের রেফারেন্স বের করে দেবেন। কোনও পত্রিকা হয়ত সাতাশ বছর আগে পুরুলিয়ার কোনও অখ্যাত গ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। কোনওটা হয়ত কোনও লোকসংস্কৃতির গবেষকের বই। এমন সব বই যা হয়ত স্বয়ং লেখকের পরিবারের লোকের কাছেও পাওয়া যাবে না। ধরা যাক, আপনি বীরভূমের কোনও এক লেখকের কয়েকটা গল্পের সন্ধান করছেন। কিন্তু সেইসব গল্প বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। উদ্ধার করতে পারেন একজন, তাঁর নাম সন্দীপ দত্ত।

প্রায় ৪৫ বছর ধরে সযত্নে আগলে রেখেছিলেন এই লাইব্রেরি। কত হাজার হাজার গবেষক পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছেন এই লাইব্রেরির সাহায্য নিয়ে। কত হাজার হাজার বইয়ের আতুরঘর হল এই লাইব্রেরি। কত লেখককে তাঁদের হারানো লেখা খুঁজে দিয়েছে এই লাইব্রেরি। কিন্তু মানুষটি প্রচারের আড়ালেই থেকে গেলেন। না পেলেন সরকারি অনুদান। না পেলেন সরকারি স্বীকৃতি। অবশ্য সেসবের প্রত্যাশীও ছিলেন না। কিছুটা আক্ষেপ নিয়েই বলতেন, ‘‌যাঁরা সরকার চালান, তাঁরা কি এসবের মর্ম বুঝবেন?‌ তাঁদের কত কাজ!‌ কত ক্লাবে টাকা দিতে হয়!‌ তাঁরা খামোকা এইসব লাইব্রেরিকে টাকা দিতে যাবেন কেন?‌’‌ কিন্তু আপনার অবর্তমানে এই লাইব্রেরির কী হবে?‌ এই প্রশ্নটা বারেবারেই শুনতে হয়েছে। নিজেও কি ভাবেননি?‌ নিশ্চিতভাবেই এই ভাবনাটা আজীবন তাঁকেও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। কখনও বলেছেন, ‘‌যাঁরা ভালবাসেন, তাঁরাই বাঁচিয়ে রাখবেন।’‌ আবার কখনও আক্ষেপ নিয়ে বলেছেন, ‘‌এরপর একদিন আপনি বেল বাজাবেন। কিন্তু দরজা খুলবে না।’‌

নিশ্চিতভাবেই এই লাইব্রেরি থেকে উপকৃত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। তাঁদের নস্টালজিয়ায়, কৃতজ্ঞতায় হয়ত থেকে যাবে এই লাইব্রেরির কথা। কিন্তু একটা প্রতিষ্ঠানকে ভালবাসা এক জিনিস আর তাকে বুক দিয়ে আগলে রাখা আরেক জিনিস। যে দরদ নিয়ে সন্দীপ দত্ত এই লাইব্রেরিকে আগলে রাখতেন, সেই দরদ কি অন্য কারও মধ্যে দেখা যাবে?‌ তিনি যেমন এনসাইক্লোপিডিয়া ছিলেন, দুষ্প্রাপ্য পত্রপত্রিকার খবর রাখতেন, কোথায় কী মণিমুক্তো আছে, তার সন্ধান জানতেন, সেটা কি আর কারও পক্ষে জানা সম্ভব?‌ বই হয়ত থাকবে, কিন্তু এভাবে কোন তাকে কোনটা আছে, ধুলো ঝেড়ে খুঁজে বের করবেন কে?‌ তাই দুশ্চিন্তা থেকেই যায়।

একজন মানুষ পাঁচ দশক ধরে এমন একটা কাজ করে গেলেন। আমরা কতটুকুই বা খোঁজ রেখেছিলাম!‌ এখন সেলিব্রিটির বৃত্ত থেকে কিছুটা বেরিয়ে এসে এমন সৃষ্টিশীল মানুষদের পদ্মসম্মান দেওয়া হচ্ছে। তাঁর কথা কারও মাথায় এল না!‌ রাজ্য সরকারের নানা ‘‌ভূষণ’‌, ‘‌শ্রী’‌ আছে। যাঁরা নাম বাছাই করেন, তাঁরা কি জানতেন এই সন্দীপ দত্তর কথা!‌ তাঁর এই সুবিশাল কর্মকাণ্ডের কথা!‌ তারপরেও তাঁর নাম বিবেচনায় এল না!‌

ভয় হয়, এমন সুন্দর একটা লাইব্রেরি, কালের গর্ভে তলিয়ে যাবে না তো?‌ যদি সত্যি এমন পরিণতি হয়, সেটা কতবড় ক্ষতি, তা বোঝার মতো সংবেদনশীল মন সত্যিই কি আমাদের আছে?‌
‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.