উত্তম দাস
খুব ঘটা করে পালিত হল কলকাতায় ট্রামের ১৫০ বছর। অর্থাৎ, ঠিক ১৫০ বছর আগে, ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে এই শহরে প্রথম ট্রাম চলেছিল। হ্যাঁ, ঘটা করে পালিত হওয়ারই কথা। কিন্তু কলকাতায় ট্রাম এখন যেন শিবরাত্রির সলতে। বছর দশেক আগেও নাকি ২৬টি রুটে ট্রাম চলত। কমতে কমতে এখন দুটি রুটে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সকলের চোখের সামনে কীভাবে একটু একটু করে ট্রাম হারিয়ে গেল! আমরা বুঝতেও পারলাম না।
সেদিন সকালে আমরা কয়েকজন বেরিয়ে পড়লাম। বলা যায়, পুরনো কলকাতা অভিযানে। ইচ্ছে ছিল, প্রথমে ট্রামে চড়ে খিদিরপুর যাব। সেখান থেকে মেটিয়াবুরুজের ইমামবাড়ায়। বলা ভাল, নবাব ওয়াজেদ আলির সমাধিক্ষেত্রে। অর্থাৎ, এক হেরিটেজে চড়ে আরেক হেরিটেজে।
শীতকালে মাঝে মাঝেই আমরা কয়েকজন এভাবে বেরিয়ে পড়ি। হয়ত হারানো শৈশব, কৈশোরকে খুঁজে বেড়াই। হয়ত সেই ফেলে আসা কলকাতার গন্ধ নিতে যাই। কিন্তু হায়, ধর্মতলায় গিয়ে দেখলাম, ট্রামের দেখা নাই রে, ট্রামের দেখা নাই।
বছর তিনেক আগে বার দুই ট্রামে চড়ে খিদিরপুর গিয়েছিলাম। সেটা মূলত, ভোরের ময়দানকে ট্রাম থেকে দেখার আশায়। ময়দানের সবুজ ঘাসের মাঝ দিয়ে সাতসকালে ট্রাম ছুটে চলেছে। এ এক অন্য মাদকতা। যাঁরা বোঝেন, তাঁরা বোঝেন। তখনই শুনেছিলাম, ট্রাম ডিপোতে নাকি সংস্কার চলছে। তাই এখন ট্রাম ধরতে হবে শহিদ মিনার থেকে। তাই সই। শহিদ মিনার থেকেই ট্রাম ধরেছিলাম।
তারপর লকডাউনের চোখরাঙানি। গণপরিবহণে বড় এক ধাক্কা। তখনকার মতো ট্রাম বন্ধ রাখাটা হয়ত স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু তারপর তো এক এক করে সবই স্বাভাবিক হয়ে এল। শুধু ট্রামই নিঃশব্দে চলে গেল বাতিলের খাতায়। ধর্মতলা–খিদিরপুর রুটে কত বছর ধরে ট্রাম চলে আসছে। তা কি চিরতরে অতীত হয়ে গেল?
বেশ রাগই হচ্ছিল। এই শহরের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ট্রাম। ভারতের আর কোনও শহরে আছে বলে জানা নেই। এই গতির দুনিয়ায় সারা শহরজুড়ে ট্রাম চালানো হয়ত সম্ভব নয়। তাই অনেক ব্যস্ত রাস্তায় স্বাভাবিক নিয়মেই ট্রাম উঠে যাবে। কোথাও হয়ত মেট্রো রেলের কাজ হচ্ছে। আবার কোথাও রাস্তায় যানজট তৈরি হচ্ছে। কিন্তু খিদিরপুর যাওয়ার রাস্তা তো বিরাট ব্যস্ত রাস্তা নয়। তাহলে, এই রাস্তায় ট্রাম ছুটতে বাধা কোথায়? তাছাড়া, ট্রাম লাইনের অনেকটাই মূল রাস্তার বাইরে। ফলে, যানজট তৈরি হওয়ার বা রাস্তা খারাপ হওয়ার তেমন আশঙ্কাও নেই। অন্তত এই রাস্তায় কি ট্রামকে বাঁচিয়ে রাখা যেত না?
ট্রাম বন্ধ করে দেওয়া হবে, এমনটা কেউই বলেন না। বারবার আশ্বাস দেওয়া হয়, নতুন রূপে ফিরে আসছে ট্রাম। সবকিছু নাকি আরও ঢেলে সাজানো হবে। কিন্তু একের পর এক রুটের ট্রাম কেমন নিঃশব্দে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। শোনা যায়, অনেক ট্রাম ডিপো নাকি বেসরকারি সংস্থাকে দীর্ঘমেয়াদি লিজে দেওয়া হয়েছে। এভাবে জমিগুলো জলের দরে বিক্রি আর সেখান থেকে মোটা কাটমানির জন্য ট্রামকে আস্তে আস্তে কবরে পাঠানো হচ্ছে না তো? মাঝে মাঝেই প্রশ্ন জাগে, সরকার আদৌ ট্রামকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় তো!