চুনী সেই ছোট্ট শিশু, বলরাম মানে সেই পুরনো চাকর

ধীমান সাহা

চুনী হল বাড়ির সেই ছোট্ট শিশু। যে সবার খুব আদরের। সারাদিন দুষ্টুমি করে।গোটা বাড়ি একেবারে মাতিয়ে রাখে। আর বলরাম হল বাড়ির সেই বৃদ্ধ চাকর। যার উপস্থিতি সেভাবে বোঝা যায় না। অথচ, সেই লোকটা যেদিন থাকে না, সবকিছুই কেমন এলোমেলো হয়ে যায়।চুনী আর বলরাম, কে সেরা, এই বিতর্ক বহুকালের। সেই ছোট্ট শিশু আর বৃদ্ধ চাকরের উপমাটা বহুদিন থেকেই চলে আসছে।

তিনি একরোখা, তিনি জেদি, তিনি অভিমানী। যাই বলুন, এটাই তুলসীদাস বলরাম। চিরকাল মাথা উঁচু করে পথ চলা একজন মানুষ। এখানেই বাকিদের থেকে তিনি অনেকটা আলাদা।

প্রায় পাঁচ দশক আগে ঘোষণা করেছিলেন, আমার মৃতদেহ যেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে না যায়। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁকে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে টলানো যায়নি। তাই, তাঁর মৃতদেহ ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে গেল না। হাসপাতাল থেকে সোজা চলে গেল উত্তরপাড়ায়। যেখানে তিন দশকের বেশি সময় ধরে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে গিয়েছিলেন।

ততদিনে ছাপ্পান্নর অলিম্পিকে খেলা হয়ে গেছে। হায়দরাবাদের হয়ে দু’‌বার সন্তোষ ট্রফিতেও জেতা হয়ে গেছে। তাঁকে আনতে হায়দরাবাদে লোক পাঠালেন জেসি গুহ। যিনি গেলেন, তিনি পঞ্চপাণ্ডবের অন্যতম ধনরাজ। জেসি গুহর নির্দেশ, যেভাবেই হোক, বলরাম ও নারায়ণকে ধরে আনতে হবে। কিন্তু আসার সময় ধনরাজ একটা টোটকা দিয়েছিলেন, ‘‌কলকাতায় গিয়ে কিন্তু কাদামাঠে খেলতে হবে। তাই ভেজা মাঠ, কাদা মাঠে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। সেইভাবে প্র‌্যাকটিস করতে হবে।’‌

বলরামকে এনে তোলা হল ইস্টবেঙ্গলের হোস্টেলে। একদিন মাঝরাতে প্রবল বৃষ্টি। বলরামের হঠাৎ মনে হল, এই সময় মাঠে গেলে কেমন হয়। সেই মাঝরাতেই নারায়ণকে নিয়ে হাজির হয়ে গেলেন ইস্টবেঙ্গল মাঠে। প্র‌্যাকটিস চলতে লাগল। কথাটা জেসি গুহর কানে গেল। তিনি প্রচণ্ড ধমক দিলেন বলরামকে। মাঝরাতে বৃষ্টিতে ভিজে তোমাকে কে প্র‌্যাকটিস করতে বলেছে?‌

বলরাম যেন এসেই ফুল ফোটাতে শুরু করে দিলেন। একের পর এক ট্রফি এল ইস্টবেঙ্গলের ঝুলিতে। গোল করলেন, করালেন। একবার লিগে পরপর দুবার হারালেন মোহনবাগানকে। দুবারই বলরামের গোল। এবার যা হয়!‌ মোহনবাগান সভাপতি ধীরেন দের নজর পড়ে গেল। চুনী তো ছিলেনই। পাশে বলরামকেও যদি পাওয়া যায়, তাহলে আর দেখে কে!‌ একদিন বলরামকে নিজের বাড়িতে ডেকে পাঠালেন ধীরেন দে। নানা কথার পর হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিলেন। বলরাম খাম খুলে দেখলেন একটা চেক। তাতে কোনও অঙ্ক বসানো নেই। ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারলেন না। তখন ধীরেন দে বললেন, আমি ইচ্ছে করেই অঙ্ক বসাইনি। তুমি তোমার ইচ্ছে মতো অঙ্ক বসিয়ে নিও।

তখন কতই বা বয়স। এই বয়সে হাতে ব্ল্যাঙ্ক চেক। ইচ্ছেমতো অঙ্ক বসিয়ে নেওয়ার আহ্বান। যে কোনও তরুণের মাথা ঘুরে যাওয়ারই কথা। কিন্তু বলরাম খুব শান্তভাবে বললেন, আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি ইস্টবেঙ্গল ছাড়তে পারব না। জেসি গুহ আমাকে এনেছিলেন। তিনি আমাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। এখন সেই ক্লাব ছেড়ে দেওয়াটা খুব অন্যায় হবে। বলরামের এই সততা দেখে ধীরেন দের মতো মানুষও আপ্লুত। তবু হাল ছাড়তে নারাজ। এমন ছেলেকে তো হাতছাড়া করা যায় না। তাই, বলরামের কাছে পাঠালেন চুনী গোস্বামীকে। চুনী গিয়ে বললেন, ‘‌বলা, চলে আয়। তুই আর আমি একদিকে। কী টিম হবে, ভাবতে পারছিস?‌ আমাদের কেউ হারাতে পারবে না।’ কিন্তু বলরাম অনঢ়। তিনি ইস্টবেঙ্গল ছাড়বেন না।

হ্যাঁ, ইস্টবেঙ্গলের প্রতি এই ছিল তাঁর কমিটমেন্ট। শত প্রলোভনেও ইস্টবেঙ্গল ছাড়তে রাজি ছিলেন না। চোটের কারণে ফুটবল থেকে দ্রুতই সরে দাঁড়াতে হয়েছিল। তবু ইস্টবেঙ্গলকেই নিজের ক্লাব মনে করতেন। কিন্তু সেই ইস্টবেঙ্গল থেকেই এমন একটা আঘাত পেয়েছিলেন, যা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভুলতে পারেননি। অনেক, অনেক দূরে সরে গিয়েছিলেন। একসময় কলকাতা ময়দানের প্রতিও বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লেন। ভবানীপুরের পাঠ চুকিয়ে আশ্রয় নিলেন সেই উত্তরপাড়ায়। গঙ্গার পাড়ে নির্জন এক আস্তানায়। ময়দানের কোনও কোলাহল তাঁকে স্পর্শ করত না।

অমুক অনুষ্ঠানের চিফ গেস্ট। অমুক সেমিনারে প্রধান বক্তা। অমুক সংগঠনের সংবর্ধনা। এসব হাতছানিকে উপেক্ষা করা কঠিন। কিন্তু এই মানুষটা একেবারেই অন্য ধাতুতে গড়া। তাই সব প্রলোভন, সব হাতছানি উপেক্ষা করে তিনি রইলেন ময়দান থেকে অনেক দূরে। নিজেকে প্রাসঙ্গিক রাখার জন্য, নিজের ছবি ছাপানোর জন্য লোকে কতকিছুই না করে। ‌কিন্তু বলরাম কখনই সেই রাস্তায় হাঁটেননি। অনুষ্ঠানে গিয়ে সেলিব্রিটি হয়ে ওঠার চেষ্টা করেননি। কেউ টাকা দিতে চাইলেও ফিরিয়ে দিয়েছেন।

কলকাতা ময়দানে অনেকেই খেলেছেন। প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। আবার নিজের রাজ্যে ফিরে গেছেন। কিন্তু বলরাম কখনই নিজের রাজ্যে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবেননি। খেলা ছাড়ার পরই ঠিক করে নিয়েছিলেন, বাকি জীবনটাও বাংলাতেই কাটাবেন। কেন নিজের রাজ্যে ফিরে গেলেন না?‌ এমন প্রশ্ন কতবার এসেছে। বলরাম পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, ‘‌কেন ফিরে যাব?‌ আমি ওখানে জন্মেছি ঠিকই, কিন্তু এই বাংলা আমাকে যা দিয়েছে, তা কেউ কোনওদিন দিতে পারবে?‌ ওখানে গেলে কেউ আমাকে চিনতেও পারবে না। কিন্তু এখানে খেলা ছাড়ার ষাট বছর পরেও লোকে মনে রেখেছে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে লোকে বলে, ওই দেখ, বলরাম যাচ্ছে। এই শ্রদ্ধা, এই ভালবাসা কোথায় পাব?‌ তাই এই বাংলা ছেড়ে কোথাও যাব না। এটাই আমার ঘর।’‌

কজন বলতে পারেন এমন কথা?‌ বাংলা সম্পর্কে এমন গর্ববোধ কজনের মধ্যে আছে?‌ তাই, অনেক বাঙালির থেকেও তিনি অনেক বেশিমাত্রায় বাঙালি।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.