এই রাজ্যের বুদ্ধিজীবীরা জলবৎ তরলং। তাঁদের যে পাত্রে রাখা হয়, দ্রুত তাঁরা সেই পাত্রের আকার ধারণ করেন। বহুবার প্রমাণিত। সম্প্রতি তা আবার পরিষ্কার হয়ে গেল।
উপলক্ষ্য একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান। বড় গায়কের আগে গাইতে ওঠার এক বিড়ম্বনা আছে। মাঝে মাঝেই হাততালি পড়ে। সেই হাততালি অবশ্য ভাল গানের জন্য নয়। আসলে, দর্শক–শ্রোতারা বুঝিয়ে দেন, অনেক হয়েছে বাপু, এবার মানে মানে কেটে পড়ো।
সরকারি অনুষ্ঠান মানে শেষবেলায় মুখ্যমন্ত্রী বলবেন, এটাই দস্তুর। অন্যরা তাঁদের মতো বলবেন, মুখ্যমন্ত্রী তাঁর মতো বলবেন, এমনটা হলে কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু মুশকিলটা হল, এখানে বক্তৃতা দিতে উঠলে মুখ্যমন্ত্রী কী চান, সেটা ভাল করে বুঝে নিতে হবে। তাঁর সুখ্যাতি করে যেতে হবে। পারলে, ভাষা দিবসের পেছনে মুখ্যমন্ত্রীর বিরাট অবদান, ইউনেস্কোর স্বীকৃতির পেছনেও মুখ্যমন্ত্রী, এই জাতীয় প্রশস্তি গাইতে হবে।
বেচারা শুভাপ্রসন্ন। বলে বসলেন, বাংলা ভাষায় বহু অবাঙালি শব্দ ঢুকে পড়ছে। পানি, দাওয়াত ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রশ্ন তুললেন, আমরা কি জল বলতে পারি না? এই কথাটাই মুখ্যমন্ত্রী বললে, ধন্য ধন্য রব পড়ে যেত। সবাই দু ঢোক বেশি করে জল খেয়ে বসতেন। কিন্তু সভার মাঝেই মুখ্যমন্ত্রী বলে বসলেন, শুভাপ্রসন্নর এই মন্তব্য তিনি পছন্দ করছেন না। পানি বলায় তাঁর কোনও আপত্তি নেই। লোকে বুঝতে পারলেই হল।
এটা ঘটনা, বাংলা ভাষায় নানা শব্দ মিশে আছে। সেগুলি কালক্রমে বাংলাই হয়ে উঠেছে। কিন্তু যেহেতু মুখ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, পানি চলবে, অতএব, সবাই রে রে করে উঠলেন শুভাপ্রসন্নর দিকে। যদি মুখ্যমন্ত্রী এমনটা না বলতেন, তাহলে বাকিরাও হয়ত শুভাপ্রসন্নর সুরেই সুর মেলাতেন। ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’ হয়ে যেতে সময় লাগত না। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি যা বলার মুখ্যমন্ত্রী বলার আগেই বলেছেন। ফলে, তাঁরা মতামতটা তাঁর মতামত হিসেবেই ধরা যায়। কারণ, তাঁর কথার সুর অন্তত মুখ্যমন্ত্রী বেঁধে দেননি। কিন্তু বাকিরা! তাঁদের সুরটা যেন মুখ্যমন্ত্রীই বেঁধে দিলেন।
আসলে, মুখ্যমন্ত্রী ধরে আনতে বললে, পারিষদরা পারলে বেঁধে আনেন। সবাই গাল পাড়তে লাগলেন শুভাপ্রসন্নকে। শুভাপ্রসন্নর বক্তব্যের সঙ্গে অনেকে একমত না হতেই পারেন, তাই বলে তাঁকে চারিত্রিকভাবে এভাবে হেনস্থা করা খুব দরকার ছিল? বিশেষ কারও অনুমোদন বা প্রশ্রয় ছাড়া এভাবে তাঁকে হেনস্থা করা যেত? মুখ্যমন্ত্রীকে কে কতখানি তুষ্ট করতে পারেন, তার যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। শুধু পানির পক্ষে জোরালো সওয়াল করেই তাঁরা থেমে থাকলেন না, শুভাপ্রসন্ন কতটা খারাপ, সেটা নিয়ে বলতেই যেন বেশি উৎসাহী হয়ে উঠলেন কেউ কেউ।
এক দুটো বিষয়ে কারও একটু ভিন্ন মত থাকতেই পারে। তাই বলে এভাবে তাঁকে আক্রমণ করতে হবে? যেহেতু মুখ্যমন্ত্রী একবার বলে দিয়েছেন, পানি চলবে, অতএব, পানিকে জোর পূর্বক চালাতেই হবে। পারলে, যাঁরা জল বলতেন, তাঁরাও পানি বলতে শুরু করেন আর কী। একটা মামুলি কথার জন্য এতখানি হেনস্থার শিকার শুভাপ্রসন্ন এর আগে কখনও হয়েছেন! স্তাবকতা কী কঠিন বস্তু, শুভাপ্রসন্ন নিশ্চয় হাড়ে হাড়ে টের পেলেন।