স্বরূপ গোস্বামী
শীতকাল কবে আসবে, সুপর্ণা! সেই কোনকাল আগে কবি লিখে গেছেন। কোন কবি লিখে গেছেন, বাঙালির জানতে বয়েই গেছে। বাঙালি লাইনটা ঠিক মনে রেখেছে। রাখত না, যদি ‘সুপর্ণা’ নামটা না থাকত। শীতের সঙ্গে সুপর্ণার কী সম্পর্ক, আজও জানি না।
সেই শীত কখন এল, কখন চলেও গেল। গ্রীষ্মের দাবদাহ এখনও আসেনি। বলা যেতে পারে, শীত আর গরমের মাঝের একটা সাঁকো। একসময় এই সময়টাকে বসন্ত বলা হত। সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। আর সেই বসন্তও নেই।
বসন্তে যেমন হেমন্তের একঝলক টাটকা বাতাস নিয়ে আপনি হাজির হলেন। আপনি, মানে হৈমন্তী। সত্যিই, কী সুন্দর নাম। হৈমন্তী বললেই বেআক্কেলে বাঙালির মানসপটে ফুটে ওঠে হৈমন্তী শুক্লার নাম। আর সেই হৈমন্তী মানেই রাগপ্রধান আর প্যানপেনে কিছু গান। এসব শুনতে এই প্রজন্মের বয়েই গেছে।
জানেন, গুগলে সবে এইচ এ আই.. এই তিনটে শব্দ লিখেছি, অমনি চলে এল আপনার নাম, মানে হৈমন্তী গাঙ্গুলি। নানা ভঙ্গিমায় ছবির ছড়াছড়ি। মানে, মাত্র দুদিনেই সেই হৈমন্তী শুক্লাকে দশ গোল দিয়ে বসে আছেন। পরপর দু’দিন টিভির সান্ধ্যকালীন আসর জাঁকিয়ে বসলেন আপনি। কখনও ক্যামেরা ছুটল আপনার বাড়িতে, কখনও প্রতিবেশীদের বাড়িতে। কখনও আপনার অফিসে, কখনও স্টুডিওপাড়ায়। একেবারে রাতারাতি বিখ্যাত বলতে যা বোঝায়, তাই।
তবু কেউ আপনাকে খুঁজে পেল না। অথচ, আপনার বাইট নেওয়ার জন্য, আপনাকে একঝলক দেখানোর জন্য মিডিয়ার কী আকুলতা। সুচিত্রা সেনকে দেখানোর জন্যও বোধ হয় এতটা ছিল না। আপনি নাকি অভিনেত্রী, আপনি নাকি মডেল। কত পরিচয় সামনে আসছে। কই, এতদিন তো কারও জানা ছিল না। আপনি নেই, কিন্তু আপনাকে নিয়ে কতই না তর্জা। কেউ হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল, আপনার অ্যাকাউন্টেই নাকি টাকা জমা হয়েছে। আবার কেউ কেউ গোপন ডেরা থেকে বেরিয়ে এসে বিবৃতি দিল, এসব কেলেঙ্কারির সঙ্গে আপনার কোনও সম্পর্কই নেই।
ঠিক সাত আট মাস আগে, বাঙালি এভাবেই পেয়েছিল আরেক লুকোনো প্রতিভাকে। তাঁর নাম অর্পিতা। ‘অপা’ শব্দটা বাংলার দৈনন্দিন ডিকশেনারিতে ঢুকে গেল। শুনেছি, শান্তিনিকেতনে ওই ‘অপা’ বাড়িটা নাকি মিনি টুরিস্ট স্পট হয়ে গেছে। টোটো চালকরা পর্যটকদের দিব্যি সেখানে ঘোরাতে নিয়ে যাচ্ছেন। রবি ঠাকুরের বাড়ি, অমর্ত্য সেনের বাড়ি, সুচিত্রা–কণিকার বাড়ি চুলোয় যাক। বুভুক্ষু বাঙালি ছুটছে ‘অপা’ দেখবে বলে।
সাত মাস ধরে এই বুভুক্ষু বাঙালি নতুন কোনও রসদ পায়নি। নতুন কোনও লাস্যময়ী নারীর হদিশ পায়নি। রগরগে গসিপ পায়নি। চায়ের দোকানে আলোচনার তেমন খোরাক পায়নি। ফেসবুকে চুকলি কাটার মতো কোটেশান পায়নি। সেই অপেক্ষার অবসান। বাঙালি অবশেষে হৈমন্তী নামের একটা চরিত্র পেয়েছে। এই ভরা বসন্তেও হৈমন্তীর আরাধনায় সে মগ্ন হয়েছে।
তিনদিন আগেই ‘কাকু’ নামক একটা লোক একাই বাজার নিয়ে বসেছিল। পরপর দুই সন্ধ্যায় তাঁকে নিয়ে কত আলোচনা। তিনিও এন্তার বাইট দিয়ে চলেছিলেন। মূলস্রোত মিডিয়া থেকে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ইউটিউব চ্যানেল কাউকেই নিরাশ করছিলেন না। বেশ একটা সেলিব্রিটি স্টেটাস উপভোগ করছিলেন।
হালফিলের বাংলায় কতগুলো অনুষঙ্গ আপনাআপনিই এসে যায়। রাজ্য বললেই কেন্দ্র এসে যায়, কোর্ট বললেই সিবিআই এসে যায়, বৈশাখী বললেই শোভন এসে যায়। তেমনই ‘কাকু’ বললেই উল্টো একটা শব্দও এসে যায়। বলা হয়, কান টানলে নাকি মাথা আসে। কাকুকে নিয়ে টানাটানি করলে যদি সেই উল্টো শব্দটা এসে যায়!
কাহিনিতে একটা টুইস্ট চাই। গল্পে একটু মোচড় চাই। ব্যস, চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে আপনার আবির্ভাব। যেই না, হৈমন্তী নামটা একবার ভেসে উঠল, যেই না ফেসবুকের সৌজন্য দু–একটা লাস্যময়ী ছবি সামনে এল, অমনি সুপার ডুপার হিট। আলোচনা কোনদিক থেকে কোনদিকে ঘুরে গেল। বুদ্ধিটা যার মাথা থেকেই আসুক, সে গোটা রাজ্যকে ঘোল খাইয়ে ছাড়ল। সুড়সুড়ি খোঁজা মিডিয়া আর বুভুক্ষু বাঙালি সেই স্রোতেই দিব্যি ভেসে গেল।
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, কার পৌষমাস, কার সর্বনাশ। আচ্ছা হৈমন্তী, আপনার সর্বনাশ নাকি পৌষমাস। বেশ জটিল ধাঁধা। নিভৃতে, নিরালায় আপনি নিজেও হয়ত তেমনটাই ভাবছেন। মাত্র দুদিনে কী পাবলিসিটি। যা সারাবছর সাধনা করলেও পাওয়া যায় না।
আপনি সত্যিই এক মোক্ষম তাস। যে তাস কত বাতাসকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেয়। বুভুক্ষু বাঙালি যতদিন আরও কোনও লাস্যময়ী নারীকে না পাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত আপনাকে নিয়ে মেতে থাকুক। সেই সুযোগে রাঘব বোয়ালরা আরও গভীর জলে হারিয়ে যাক।
হৈমন্তী, দোষটা আপনার নয়। এই বুভুক্ষু বাঙালি যতদিন থাকবে, ততদিন ধেড়ে ইঁদুরেরাও বহাল তবিয়তেই থাকবে।