অজয় নন্দী
আটের দশকে একটা হিন্দি ছবির নাম ছিল, ‘অ্যালবার্ট পিন্টো কো গুসসা কিঁউ আতা হ্যায়’।
সময় বদলে যায়। অ্যালবার্ট পিন্টোরাও বদলে যায়। বদলে যায় তাদের রাগের কারণগুলো।
আমাদের ক্রীড়ামন্ত্রীর খুব গোঁসা হয়েছে। বাংলা কেন সন্তোষ ট্রফিতে হারল। বাংলা কেন রনজি ফাইনালে হারল, তার কারণ খুঁজতে লেগে পড়েছেন আমাদের ক্রীড়ামন্ত্রী।
গত কয়েক বছরে কারও পদক পাওয়ার উপায় নেই। অমনি তাঁকে ধরে আনা হবে নিউ সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ে। ‘মাননীয় মন্ত্রী’ তাঁর হাতে ফুলের তোড়া তুলে দেবেন। ইচ্ছে থাক না থাক, তাঁকে সংবর্ধনা নিতেই হবে। মোদ্দা কথা, মন্ত্রীকে ছবি ছাপানোর সুযোগ দিতেই হবে।
রনজি ফাইনাল শুরুর আগেই তিনি বলে বসলেন, তখন বিধানসভার অধিবেশন চলবে। তবু আমি রোজ ক্রিকেটারদের উৎসাহিত করতে যাব। অর্থাৎ, রোজ আমার ছবি ছাপতে হবে। টিভিতে আমাকে দেখাতে হবে।
যেমন কথা, তেমন কাজ। আগের দিন সটান চলে এলেন ইডেনে। চ্যালা চামুন্ডাদের নিয়ে একেবারে মাঠে। কারণ, মাঠের মধ্যে না ঢুকলে ছবিটা ঠিকঠাক হবে না। ম্যাচের আগেরদিন এভাবে মাঠে ঢুকতে নেই, এই বোধটাও ক্রীড়ামন্ত্রীর নেই।
এবার বাংলা হেরে গেল। অমনি মোহনবাগানের লাইব্রেরি উদ্বোধনে গিয়ে ক্ষোভ উগরে দিলেন ক্রীড়ামন্ত্রী। তাঁর দাবি, ফুটবল আর ক্রিকেটে কোটা সিস্টেমে দল তৈরি হয়েছে। সেই কারণেই নাকি হার। তিনি নিজে নাকি খেলোয়াড়দের উৎসাহিত করতে মাঠে এসেছেন। এর পরেও হার!
সত্যিই কী দারুণ এক মোটিভেটর। স্বয়ং সৌরভ গাঙ্গুলিও কোনওদিন দাবি করেন না, আমি ওদের উৎসাহিত করে এসেছি। সুনীল গাভাসকারও কখনও এমনটা দাবি করেন না। অথচ, ক্রীড়ামন্ত্রী মনে করেন, তিনি গেলেই সবাই বোধ হয় দারুণ উজ্জীবিত হয়ে যান। নিজের সম্পর্কে মানুষের কত ভ্রান্ত ধারণাই না থাকে!
মশাই, কে চেয়েছিল আপনার উপস্থিতি? কে বলেছিল, আপনি এলে সবাই দারুণ উজ্জীবিত হবে! মোদ্দা কথা, যাবতীয় প্রচাচ ইডেনে, ক্যামেরা ইডেনে। সেখানে গেলে ছবি উঠবে। এই হ্যাংলামির তাড়নাতেই নানা জায়গায় যান। ইডেনেও এসেছিলেন। আপনি যে কতটা অবাঞ্ছিত, আপনার উপস্থিতি যে কারও কাছেই কাঙ্খিত নয়, এটুকু বোঝার মতো বুদ্ধিও আপনার নেই। থাকার কথাও নয়। তিনি শুধু বোঝেন ছবি। তাই কোনও খেলোয়াড় আইসিসিইউ–তে ভর্তি থাকলে সেখানেও ক্যামেরা নিয়ে ঢুকে যান। সেখানেও পোজ দিয়ে ছবি তোলেন। তারপর আপ্ত সহায়ক মারফত পৌঁছে যায় কাগজের দপ্তরে। একবারও মনে হয় না যে, এরকম মরণাপন্ন লোকের পাশে দাঁড়িয়ে ফটো সেশন করতে নেই।
এই ক্রীড়ামন্ত্রী প্রতি বছর বেটন কাপে প্রাইজ দিতে চলে যান। প্রতিবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসেন, পরেরবার বেটন কাপ হবে নতুন অ্যাস্ট্রো টার্ফে। বেটন কাপের পরেরদিন এই লাইনটা দিয়েই কাগজের হেডিং হয়। ক্রীড়াদপ্তর আজও সেই অ্যাসট্রো টার্ফ বানাতে পারল না। তবু প্রতিবছর প্রাইজ দিতে (থুড়ি, ছবি তুলতে) পৌঁছে যান।
খেলাধূলায় নাকি আগের থেকে অনেক বাজেট বেড়েছে। সেই বাজেট দিয়ে কটা নতুন স্টেডিয়াম তৈরি হয়েছে? প্রতি বছর নেতাজি ইনডোরে ঘটা করে ক্লাবকে টাকা বিলি করা হয়। সেই টাকা কোন দপ্তরের বাজেট থেকে যায়? সেই টাকায় কোন ক্লাব কী পরিকাঠামো তৈরি হয়েছে? সেই টাকায় দুর্গাপুজো হয়, ভোট কেনা হয়, মিছিলে লোক জড়ো করা হয়। তার সঙ্গে খেলার কী সম্পর্ক? ক্লাবে খয়রাতির টাকাকে ক্রীড়াদপ্তরের সাফল্য বলে চালাতে চাইছেন?
আইএফএ–তে নাকি নাকি কোটা সিস্টেম। আপনার মতো লোকেরা ক্রীড়ামন্ত্রী থাকলে কোটা সিস্টেম তো থাকবেই। আচ্ছা, আইএফএ–র সভাপতি কে? অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। কী তাঁর পরিচয়। মুখ্যমন্ত্রীর দাদা। তাঁকে সভাপতি বানাতে আইএফএ–র সংবিধান বদলাতে হয়েছে। আচ্ছা, আইএফএ–র সহ সচিব কে? স্বরূপ বিশ্বাস। আপনার গুণধর ভাই। না, দূরসম্পর্কেই ভাই নয়। খুড়তুতো, জ্যাড়তুতো ভাই নয়, একেবারে বাবাতুতো ভাই। কোন যোগ্যতা বলে তিনি আইএফএ–র সহ সচিব হন?
চিরকাল জেনে এসেছি, পঞ্চম ডিভিশন থেকে চতুর্থ ডিভিশনে, সেখান থেকে তৃতীয়, দ্বিতীয় হয়ে প্রথম ডিভিশনে আসতে হয়। আবহমান কাল ধরে এটাই হয়ে এসেছে। এবার কোন প্রভাব বলে চার প্রভাবশালী নেতার চারটে দল সরাসরি প্রথম ডিভিশনে খেলার ছাড়পত্র পেয়ে গেল? সেই তালিকায় যেমন ডায়মন্ড হারবার আছে, তেমনই আপনার সুরুচি সংঘও আছে। আছে সুজিত বসু আর মদন মিত্রর ক্লাবও। ক্রীড়ামন্ত্রীর ক্লাবকে সব নিয়ম ভেঙে প্রথম ডিভিশনে খেলানো হল।
যারা জোর করে, সব নিয়ম বদলে দিয়ে নিজের ক্লাবকে প্রথম ডিভিশনে ঢোকাতে পারে, তারা নিশ্চিতভাবেই দল গঠনে বা কোচ নির্বাচনেও নিজেদের প্রভাব খাটাবে। হয়ত তাঁর সব কথা শোনা হয়নি, সেই কারণেই এই গোঁসা।
আইএফএ বা সিএবি–র দল নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন বা বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে এটা যে ওপেন ফোরামে বলা যায় না, এটুকু শিষ্টাচার বা সৌজন্যও তাঁর নেই। জিতলে দন্ত বিগলিত করে ছবি তুলব। সরকারের সাফল্য বলে প্রচার করব। আর হারলে দায়টা অন্যদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেব। এমন ক্রীড়ামন্ত্রীর কাছ থেকে তো এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণই প্রত্যাশিত।