ভাগ্যিস বিদেশিরা বাংলা পড়তে পারেন না

প্রায় বাইশ বছর আগের কথা। বইমেলার শেষদিন। একটি ছবি ও তার অভিনব একটি ক্যাপশন। সেই মজার ঘটনার স্মৃতিচারণ করলেন সরল বিশ্বাস।।

বইমেলার শেষদিন বলতেই বাইশ বছর আগের একটি ঘটনা মনে পড়ে যায়। বেশি ভূমিকায় না গিয়ে সরাসরি বিষয়ে ঢুকে পড়া যাক। এই প্রতিবেদক তখন সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় টুকটাক ফ্রিল্যান্স করতাম। কোথাও পারিশ্রমিক পাওয়া যেত। অধিকাংশ জায়গাতেই ফ্রিতে লেখালেখি।

তখনকার সময়ের এক জনপ্রিয় সাপ্তাহিক। ঠিক হল, বইমেলার বারোদিন রোজ কাগজ বেরোবে। দুপুরের মধ্যে ছাপা হয়ে যাবে। দুপুরেই হকার সোজা বইমেলায় চলে যাবে। যা বিক্রি হবে, মূলত বইমেলায়। রাজনীতি, খেলা, সিনেমা–‌সব ধরনের খবরই থাকত। তবে বেশিরভাগ খবর ও প্রতিবেদন ও ছবি থাকত বইমেলা সংক্রান্ত। বেশিরভাগ দিনই লিড স্টোরি আমিই লিখতাম। আগেরদিনেই অনেক সময় লিখে রাখা হত। কম্পোজ হয়ে থাকত।

শেষদিন। সেদিনেরও লিড স্টোরি লেখার দায়িত্ব আমার উপর। শেষদিন মানে, কেমন একটা মন খারাপের ব্যাপার। এতদিনের এত ব্যস্ততা, বইপ্রেমীদের এই উৎসব, সব যেন অতীত হয়ে যাবে। বিদায় বেলার একটা করুণ সুর যেন বেজে উঠবে। মূলত এইরকম আবেগের ছোঁয়া দিয়েই লিড স্টোরিটা লেখা হয়েছিল। আগের রাতেই বাড়ি থেকে লিখে ফেলেছিলাম। সকালে সেটা প্রেসে যাবে।

সম্পাদক মশাই লেখাটা পড়লেন। বললেন, খুব ভাল হয়েছে। তবে অ্যাঙ্গেলটা একটু বদলে দে। কী অ্যাঙ্গেল করব?‌ উনি নিজেই ঠিক করে দিলেন। শেষদিন, রবিবার। রেকর্ড ভিড় হবে। রেকর্ড ভিড় মানেই রেকর্ড বই চুরি। তাই শেষদিন বই চুরির আতঙ্কে ভুগছে প্রকাশকরা। এই অ্যাঙ্গেলে লেখাটা হবে।
হাতে অল্প সময়। চটপট কয়েকজন প্রকাশককে ফোনে ধরা হল। অন্যান্যবার কী রকম বই চুরি হয়, এবার কী রকম চুরি হচ্ছে?‌ কোন ধরনের বই বেশি চুরি হয়? অন্যান্য চোরদের সঙ্গে বইচোরদের তফাত কোথায়?‌ এদের ‘‌পবিত্র পাপি’‌ বলা যায় কিনা?‌‌ মূলত কোন বয়সের লোকেরা বেশি বই চুরি করে?‌ কেন চুরি করে?‌ পড়ার জন্য নাকি বিক্রি করার জন্য, নাকি বন্ধুদের কাছে সস্তা ক্রেডিট নেওয়ার জন্য?‌ ধরা পড়লে তাদের কী ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়?‌ পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয় নাকি ধমক দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়?‌ এই জাতীয় নানারকমের প্রশ্ন করা হল। দারুণ দারুণ সব উত্তর উঠে এল।

ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে যুদ্ধ। দ্রুত লেখাটা লিখে ফেললাম। এডিটর মশাই চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘‌ভাল হয়েছে। এটাই চেয়েছিলাম। এই লেখাটা দারুণ হিট হবে।’‌ লেখাটা কম্পোজে চলে গেল। এবার ছবি বাছার কাজ শুরু। ছোট কাগজ। হাতে বেশি ছবি ছিল না। তখন গুগলে এসব ছবি পাওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। একদিন একজন ফটোগ্রাফার গিয়ে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে এনেছিল। সেই ছবিগুলোই একেকদিন একেকটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ছাপা হত। যেগুলো বের করা হল, সবগুলোই আগের কয়েকদিনে ছাপা হয়ে গেছে। একটা ছবি ছাপা হয়নি। সেটা হল, একটি স্টলে কয়েকজন বিদেশি পর্যটক বই নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন।

সম্পাদক মশাই সেই ছবিটাই পাঠিয়ে দিলেন স্ক্যান করতে। মনে খটকা লাগল, এই লেখার সঙ্গে এই ছবির কী সম্পর্ক?‌ সেই খটকার কথা সম্পাদক মশাইকে জানালাম। তিনি খুব একটা পাত্তা দিলেন না। বললেন, বই চুরির তো ছবি হয় না। যা হোক কিছু একটা ছবি দিলেই হবে। কিন্তু মনটা তখনও খচখচ করছে। এই যে লেখা, তার সঙ্গে এই ছবির কী সম্পর্ক?‌ ছবিটাকে তো জাস্টিফাই করতে হবে। এর ক্যাপশানই বা কী হবে?‌

ছবি স্ক্যান হয়ে এল। সম্পাদক মশাই তার তলায় ক্যাপশান করলেন— বই চুরিতে পিছিয়ে নেই বিদেশিরাও।

ভেবে দেখুন, কোন কপির সঙ্গে কোন ছবি!‌ তার সঙ্গে কী অসাধারণ একটা ক্যাপশন। ভাগ্যিস, বিদেশিরা বাংলা পড়তে পারে না।‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.