শুরুর সেই উষ্ণতা কোথায় যে হারিয়ে গেল

কুন্তল আচার্য

কে সেরা, পেলে নাকি মারাদোনা?‌ সেই ছোট থেকেই এমন একটা তুলনা শুনে আসছি। কেউ প্রবলভাবে মারাদোনাপন্থী। আবার যাঁরা একটু পুরনো, তাঁরা ঝুঁকে পেলের দিকে। দু’‌পক্ষেই কিছু যুক্তি আছে। আবার কোথাও কোথাও যুক্তিকে ছাপিয়ে যায় আবেগ। কেউ হয়ত পেলের খেলাও দেখেননি, মারাদোনার খেলাও দেখেননি। শুধুমাত্র লোকের মুখে শুনেও কোনও একটা পক্ষ নিয়ে নিলেন।

আসলে, আমাদের জীবনে আমরা ছোট থেকেই একটা তুলনা টেনে বসি। গান্ধীজি নাকি নেতাজি?‌ উত্তম নাকি সৌমিত্র?‌ গাভাসকার নাকি কপিলদেব?‌ হেমন্ত নাকি মান্না দে?‌ এমন কত তুলনা আমরা অহরহ করে বসি। গত কয়েক দশকে এই তুলনা এসে দাঁড়িয়েছে মেসি বনাম রোনাল্ডোকে। তবে বিশ্ব ফুটবলের নিরিখে পেলে বনাম মারাদোনার তুলনাটা বোধ হয় চিরন্তন।

আমরা হয়ত একজনরে আরেকজনের চরম প্রতিপক্ষ হিসেবেই দেখে এসেছি। কিন্তু সম্প্রতি ক্রীড়া সাংবাদিক জিসি দাসের লেখায় দু’‌জনের পারস্পরিক সুসম্পর্কের ওপর অনেক অজানা দিক জানতে পারলাম। এই ঘটনাগুলো আমাদের জানাই ছিল না। বেঙ্গল টাইমসের পাঠকদের জন্য তার কিছুটা নির্যাস তুলে ধরাই যায়।

পেলে মারাদোনাকে চেনেন একেবারে যুব বিশ্বকাপেরও আগে থেকেই। তখনও মারাদোনাকে ফুটবল বিশ্ব চেনেনি। এমনকী খোদ আর্জেন্টিনার ফুটবল অনুরাগীরাও সেভাবে চিনতেন না। মারাদোনার বয়স তখন সবে আঠারো। সেবার আর্জেন্টিনার মাটিতেই হচ্ছিল বিশ্বকাপ। আঠারো বছরের এই ছেলেটিকে শেষমুহূর্তে দল থেকে বাদ দিয়েছিলেন কোচ লুই সিজার মেনোত্তি। রাগে মেনোত্তির সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দিলেন মারাদোনা। ততদিনে আর্জেন্টিনস জুনিয়র্সে নাম লিখিয়েছেন। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, ক্লাবেও সময়টা ভাল যাচ্ছিল না। একটি ম্যাচে জঘন্যভাবে মারাদোনার ক্লাব হেরে গেল। ঘরে–‌বাইরে প্রবল সমালোচিত হতে লাগলেন মারাদোনা।

এমন সময় মারাদোনার কাকা পরামর্শ দিলেন পেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। মারাদোনার কাকা পেলের পূর্ব পরিচিত। সেই সূত্রেই এমন পরামর্শ দিয়েছিলেন। পেলে ততদিনে ক্লাব ফুটবল থেকেও অবসর নিয়েছেন। থাকছেন রিও ডি জেনিরোতে। সব সঙ্কোচ কাটিয়ে পেলেকে একদিন ফোন করলেন আঠারো বছরের মারাদোনা। আর্জি রাখলেন, একদিন আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। মারাদোনার কাকা আগেই পেলেকে মারাদোনার কথা বলে রেখেছিলেন। তাই মারাদোনা ফোন করতেই পেলে বললেন, তুমি কালকেই তোমার খেলার ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে আমার কাছে চলে এসো।

বুয়েন্স এয়ার্স থেকে রিও বিমানে মোটামুটি ঘণ্টা দেড়েকের পথ। মারাদোনা ক্যাসেট নিয়ে হাজির হয়ে গেলেন। হোটেলের লাউঞ্জে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন স্বয়ং পেলে। মারাদোনা আসতেই তাঁকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। গিটার বাজিয়ে গান শোনাতে শুরু করে দিলেন। এটা সেটা গল্প করতে লাগলেন। মারাদোনার বয়স তখন সবে আঠারো। স্বভাবতই কিছুটা অস্থির। যে কাজে এসেছেন, সে বিষয়ে তো কথাই হছে না। এমন সময় পেলে বললেন, চলো, ডিনার করে আসি। দুজনে নিচে নেমে ডিনারও সেরে নিলেন। তখনও ফুটবল নিয়ে তেমন আলোচনা হল না।

ডিনারের পর দু’‌জন ফের হোটেলের ঘরে ফিরে গেলেন। তারপর পেলে সেই ক্যাসেটটা দেখতে চাইলেন। রেকর্ড প্লেয়ারে চালিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। তারপর শুরু হল ক্লাস। বিভিন্ন দৃশ্য ধরে ধরে বোঝাতে শুরু করলেন। কোন জায়গায় কীভাবে ড্রিবল করা দরকার ছিল। কীভাবে বিপক্ষের ট্যাকলকে এড়াতে হয়। কীভাবে জটলার মাঝখান থেকে ছিটকে বেরোতে হয়। কীভাবে প্রতিপক্ষকে বোকা বানাতে হয়। কখন বল ছাড়তে হয়। পাস নেওয়ার জন্য কীভাবে ফাঁকায় চলে যেতে হয়। অনেকক্ষণ ধরে চলল সেই ক্লাস।

মারাদোনা দেশে ফিরে গেলেন। হাতে নাতে ফলও পেলেন। এ যেন অন্য মারাদোনা। সহজে মাথা গরম হয় না। তিনটে স্টেপ আগে থেকে দেখতে শিখেছেন। পাস বাড়িয়েই দ্রুত পজিশন বদল করছেন। সতীর্থকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, পাল্টা পাসটা কোথায় বাড়াতে হবে, সেই জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছেন। এবার এল যুব বিশ্বকাপ। মারাদোনাই দেশের ক্যাপ্টেন। ফের উড়ে গেলেন রিওতে, কিংবদন্তি পেলের পরামর্শ নিতে। সেবার সারা বিশ্ব চিনল এক নতুন তারকাকে। দেখল বিদ্যুতের ঝলক। সেবার যুব বিশ্বকাপে মারাদোনার নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হল আর্জেন্টিনা।

তখন যুব বিশ্বকাপের দিকে বিভিন্ন দেশের ক্লাবকর্তাদের নজর। আর্জেন্টিনস জুনিয়র্স থেকে এলেন বোকা জুনিয়র্সে। কিন্তু তারপরই এল ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাব থেকে লোভনীয় প্রস্তাব। মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো অঙ্ক। ঠিক এই সময় পেলে বললেন, ‘‌তোমার কাছে অনেক ডাক আসবে। প্রলোভন আসবে। কিন্তু এটাই আসল পরীক্ষা। এখন তুমি ইউরোপে যেও না। ওখানে গেলে ওই টাফ ফুটবলের সঙ্গে পেরে উঠবে না। চোট পেয়ে যাবে। তোমার খেলাটাই নষ্ট হয়ে যাবে। আমিও সারা জীবনে ব্রাজিলের ক্লাবেই পড়ে থেকেছি। আমার কাছেও অনেক ক্লাবের প্রস্তাব ছিল। গেলে হয়ত অনেক টাকা পেতাম। কিন্তু ক্লাব ফুটবলের ওই চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে দেশকে আর কিছুই দিতে পারতাম না। তিন–‌তিনবার বিশ্বকাপ দিতে পারতাম না। তোমার সামনে এখন উজ্বল ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। তোমাকে বিশ্বকাপে খেলতে হবে। এই সময় ক্লাব ফুটবলে বেশি ফোকাস করতে গেলে তুমি হারিয়ে যাবে।’‌

কিন্তু পেলের এই পরামর্শ শোনেননি মারাদোনা। বিরাট অঙ্কের চুক্তিতে সই করলেন বার্সিলোনায়। বয়স কম। ছোট থেকেই দারিদ্রের আবহে মানুষ। হয়ত সেই কারণেই টাকার অঙ্কটা দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারেননি। আবার মারাদোনার চারপাশে তখন অন্যান্য পরামর্শদাতাদেরও ভীড় বাড়ছে। নানা রকম এজেন্টরা ঘুরঘুর করছে। তারা মারাদোনাকে বোঝাল, ইউরোপের ক্লাবে না খেললে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যাবে না। বার্সিলোনার মতো ক্লাব প্রস্তাব দিচ্ছে, এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে পরে আফশোস করতে হবে। ক্লাব ফুটবলে সেরা ফুটবলারদের সঙ্গে না খেললে নিজেকে আরও পরিমার্জিত করা যাবে না। ওই কোচিং, ওই পরিকাঠামো— এর কোনও কিছুই আর্জেন্টিনায় পাওয়া যাবে না।

দ্বিতীয় পরামর্শটাই বেছে নিলেন মারাদোনা। চললেন বার্সিলোনায়। রইলেন দুটো মরশুম। প্রিয় মারাদোনা তাঁর পরামর্শকে উপেক্ষা করায় কিছুটা আঘাতই পেয়েছিলেন ফুটবল সম্রাট। যোগাযোগটাও কমে এসেছিল। মারাদোনাও সেভাবে যোগাযোগ রাখলেন না। আর পেলেও অযাচিত উপদেশ দেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখলেন। কিন্তু পেলে যে আশঙ্কা করেছিলেন, সেটাই সত্যি হল। বার্সিলোনার হয়ে নিজেকে একেবারেই মেলে ধরতে পারলেন না মারাদোনা। চোট আঘাতেই দুটো বছর কেটে গেল। বাধ্য হয়ে চলে যেতে হল ইতালির নাপোলিতে।

এরই মাঝে ছিয়াশির বিশ্বকাপ হাজির। মারাদোনাকে ঘিরে অন্য একটা প্রত্যাশার আবহও তৈরি হচ্ছে। হাজার হোক পেলে ব্রাজিলের মানুষ। তার ওপর সেবার ব্রাজিলের দলটাও দারুণ। স্বভাবতই পেলে নিজের দেশের হয়েই গলা ফাটালেন। এক সাক্ষাৎকারে আর্জেন্টিনার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে পেলে জানালেন, আর্জেন্টিনার তেমন সম্ভাবনা দেখছি না।

পেলের এই ভবিষ্যদ্বাণী মারাদোনার কানে পৌঁছল ঠিকই। কিন্তু দু’‌জনের দূরত্ব আরও বাড়তে লাগল। তাছাড়া, কেউ কেউ পেলের বিরুদ্ধে কান ভাঙানি দিয়ে সম্পর্কটাকে আরও বিষিয়ে তুলছেন। এই অবস্থায় আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়নও হয়ে গেল। প্রচার হতে লাগল, পেলের ভবিষ্যদ্বাণীকে ব্যর্থ প্রমাণ করে দিলেন মারাদোনা। কেউ কেউ একধাপ এগিয়ে তাঁকেই বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলার বলতে শুরু করে দিলেন। এতে মারাদোনার মাথা আরও কিছুটা ঘুরে গেল। পেলেকে তিনি নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করলেন। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে পেলে সম্পর্কে দু–‌একটা বিরূপ মন্তব্যও করলেন। এরপর বেরোলো মারাদোনার আত্মজীবনী। সেখানে পেলের সম্পর্কে একটি লাইনও নেই। হয়ত সচেতনভাবেই উপেক্ষা করতে চেয়েছেন। পেলের কাছে একটা খারাপ বার্তা গেল।

এবার এল নব্বই। এবারও আর্জেন্টিনা সম্পর্কে খুব একটা আশাবাদী হতে পারলেন না পেলে। বলে বসলেন, মারাদোনা এখন আগের ফর্মে নেই। নিজের সেরা সময়কে পার করে এসেছে। তাছাড়া, আর্জেন্টিনা দলের মধ্যে সেই ভারসাম্যও নেই। একার কৃতিত্বে বারবার একটা দলকে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সেবার আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু একের পর এক বাধা টপকে ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। ফাইনালেও তুল্যমূল্য লড়াই করেছিল পশ্চিম জার্মানির বিরুদ্ধে। হারতে হয়েছিল একটি বিতর্কিত পেনাল্টিতে।

সেই বছরই পেলের পঞ্চাশতম জন্মদিনে এক বিশাল প্রদর্শনী ম্যাচের আয়োজন। পেলের সম্মানে ম্যাচ বলে কথা। বিশ্বের তাবড় তাবড় খেলোয়াড়রা জানিয়ে দিলেন, তাঁরা খেলবেন। উদ্যোক্তারা চাইলেন, মারাদোনা খেলুন। স্বয়ং পেলেও চাইলেন, তাঁর পঞ্চাশ বছরের ম্যাচে মারাদোনাও যেন খেলেন। কিন্তু মারাদোনা তখন অন্য চক্রে বন্দি। তাঁরা নানা কুমন্ত্রণা দিতে লাগলেন। একসময় মারাদোনা রেকর্ড অঙ্ক দাবি করে বসলেন। সেই অঙ্ক এতটাই যে, উদ্যোক্তাদের পক্ষে তা জোগাড় করা মুশকিল। তাছাড়া, শুধু মারাদোনাকে টাকা দিলে বাকিদের মধ্যে একটা খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। তাঁরাও নিজেদের মতো করে দর হাঁকতে পারেন। তাঁদেরও মনে হতে পারে, আমরাই বা বিনা পারিশ্রমিকে খেলব কেন?‌ তখন ম্যাচটা আর সম্মান জানানোর ম্যাচ থাকবে না। আদ্যোপান্ত একটা বাণিজ্যিক ইভেন্ট হয়ে দাঁড়াবে। তবু অনেকে আশা করেছিলেন, মারাদোনা শেষপর্বে হয়ত খেলতে রাজি হয়ে যাবেন। কিন্তু শেষদিনে দেখা গেল, মারাদোনা মাঠে এলেন না। ফুটবল সম্রাটের পঞ্চাশতম জন্মদিনের আয়োজন অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনার পর দু’‌জনের দূরত্ব আরও বাড়তে লাগল।

এভাবেই দূরত্ব ক্রমশ বেড়েই গেছে। একে অন্যের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। উপহাসও করেছেন। পেলে তবু কিছুটা সংযত। কিন্তু মারাদোনা যেন লাগামছাড়া। কখনও পেলেকে বলেছেন, ফিফার এজেন্ট, কখনও বলেছেন চক্রান্তকারী। পরের দিকে সেই বরফ গলেছিল ঠিকই। কিন্তু তিক্ততার যে আবহ একটু একটু করে তৈরি হয়েছিল, তা এত সহজে মোছার নয়। শুরুর দিকের সেই উষ্ণতাটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

https://bengaltimes.in/wp-content/uploads/2023/01/new-year-2023.pdf

https://bengaltimes.in/wp-content/uploads/2023/01/new-year-2023.pdf

 

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.