ক্রিকেটে খুব চালু একটা প্রবাদ আছে। সে খেলার কীই বা বোঝে, যে শুধু খেলাটাই বোঝে। ফুটবলের ক্ষেত্রেও কথাটা বেশ সত্যি। অন্তত এবারের বিশ্বকাপ তেমনই বার্তা রেখে গেল।
আমি ঘোষিতভাবেই ব্রাজিল সমর্থক। পেলের খেলা দেখার প্রশ্নই নেই। এমনকী রোমারিওদেরও সেভাবে দেখিনি। আমার ব্রাজিল দর্শন মূলত রোনাল্ডো, রোনাল্ডিনহো, কাফু, কার্লোসদের হাত ধরে। সেই ২০০২ এ ব্রাজিল যদি ওই ফুটবল না খেলত, চ্যাম্পিয়ন না হত, আমার মনে হয়ত স্থায়ী ছাপ ফেলতে পারত না। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ফ্রিকিক থেকে রোনাল্ডিনহোর সেই অনবদ্য গোল। অনেকে বলত, ওই ফ্রিকিক আর নিতে পারবে? আমি বলতাম, নাই বা পারল, কী যায় আসে! একবার তো পেরেছে। এটাই বা কম কী? তাজমহল একবারই বানানো হয়। ‘বনলতা সেন’ বা ‘জাতিস্মর’ একবারই লেখা হয়। ‘গীতাঞ্জলি’ও একবারই লেখা হয়। ‘শোলে’ একবারই হয়। তাই বলে কি এগুলো মিথ্যে? মহৎ সৃষ্টি বারবার হয় না। কেন সেদিন রোনাল্ডিনহোর এই গোলের সঙ্গে বনলতা সেন, গীতাঞ্জলি–এসবের তুলনা টেনেছিলাম? এভাবেই খেলার সঙ্গে মিশে যায় কবিতা। ভেঙে যায় দেশ–কালের সীমারেখা। রোনাল্ডিনহোর সঙ্গে মিশে যান জীবনানন্দ, কবীর সুমন।
তখন থেকেই ব্রাজিলের অনুরাগী। ২০০৬ এ রাত জাগতাম মূলত রোনাল্ডিনহোর জন্য। কিন্তু হায়! অত্যধিক প্রত্যাশার চাপ আর বিপক্ষের কড়া নজরদারিতে সেই ফুল আর ফুটে উঠল না। একটু একটু করে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। গোকূলে যেন নীরবে বাড়ছিলেন আরও একজন, লিওনেল মেসি। তাঁরও সেবারই যাত্রা শুরু। না, সেই বিশ্বকাপে মেসিকে ভাল লাগার বা মেসি ম্যানিয়ায় আচ্ছন্ন হওয়ার কোনও কারণ ঘটেনি। সেই আবেগের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল পরের বিশ্বকাপে (২০১০)। রোনাল্ডিনহোর জন্যই রাত জেগে খেলা দেখতাম বার্সিলোনার। দেখলাম, সেই ক্লাবের জার্সিতেই নতুন তারকার উত্থান। বেশ বুঝতে পারলাম, সেই ব্রাজিল অনুরাগী মনটা একটু একটু করে কেমন যেন মেসি অনুরাগী হয়ে পড়ছে।
তবে এই আনুগত্য বদল একেবারেই অন্য এক প্রবাহ। তৃণমূলে ‘দম বন্ধ হয়ে আসছে’ বলে বিজেপিতে চলে গেলাম। বা তৃণমূল ফের ক্ষমতায় এসেছে বুঝে আবার রাতারাতি ‘উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে’ সামিল হয়ে গেলাম— ব্যাপারটা মোটেই এমন নয়। ভেতর ভেতরে একটা দ্বৈতসত্তার ঢেউ খেলে যায়। মনের একটা দিক বলে ওঠে, আহা! নেইমার ছেলেটা কী দারুণ খেলছে। ওর হাত ধরে কুড়ি বছর পর যদি বিশ্বকাপ আসে, বেশ হয়। পেলে অন্তত আরও একটা বিশ্বকাপ দেখে যেতে পারবেন। আবার মনের অন্য একটা সত্তা বলছে, এটাই মেসির শেষ বিশ্বকাপ। লোকটা এত বছর ধরে এত মানুষকে আনন্দ দিল, এত বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এত সফল, সেই লোকটা শেষবেলায় একটা বিশ্বকাপ পাবে না! নেইমারের সামনে পরেরবারও হয়ত সুযোগ থাকবে। কিন্তু মেসির সামনে তো থাকবে না। এই ট্রফিটা ও না পেলে ঠিক পোয়েটিক জাস্টিস হবে না। মনের ভেতর এই টানাপোড়েন চলতেই থাকে। ব্রাজিল অনুরাগী মনটা একটু একটু করে যেন নীল–সাদায় ঝুঁকে পড়ে। মনে হয়, এবার মেসি জিতুক।
কিন্তু এমনই এক সূচি, বুঝতে পারছিলাম, সেমিফাইনালেই হয়ত এই দুই দল মুখোমুখি হবে। সেক্ষেত্রে আমি হয়ত উভয় সঙ্কটে পড়ে যেতাম। ব্রাজিল নাকি মেসি, কাকে বেছে নিতাম! যাক, সেই ধর্মসঙ্কটে পড়তে হয়নি। ব্রাজিল কোয়ার্টার থেকেই বিদায় নিল। আমার চেতনার সাম্রাজ্য জুড়ে শুধুই মেসি। বারবার শুধু মেসির জয় চেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, এই ট্রফিটা যেন তাঁরই প্রাপ্য। অবশেষে এল সেই রাত। আমিও সেদিন চিৎকার করে উঠেছিলাম, নেচেছিলাম। অনেকে আওয়াজ দিল, ব্রাজিল–ব্রাজিল করে, আর আজ আর্জেন্টিনার জয়ে লাফাচ্ছে। ব্যাটা পাল্টিবাজ।
হয়ত ঠিকই বলছে। হয়ত এই ‘পাল্টিবাজ’ তকমাটাই আমার প্রাপ্য। মনে পড়ে গেল রবি ঠাকুরের সেই গান— ‘আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী’। হ্যাঁ, মেসির জন্য একটা রাত ‘পাল্টিবাজ’ অপবাদ নেওয়াই যায়।
পরেরবার তো আর মেসি নেই, আমার আর্জেটিনা হওয়ার দায় নেই। সেবার না হয় আবার ব্রাজিল হয়ে যাব। আবার হয়ত ‘পাল্টিবাজ’ শুনব। এবার মেসির জন্য এই অপবাদ হজম করেছি। সেবার না হয় ব্রাজিলের জন্য ‘কলঙ্কভাগী’ হব।