‌ইডেনে ফুটবল সম্রাট, ৪৫ বছর আগে

অজয় নন্দী

বাঙালির ফুটবল জীবনে তখনও সেভাবে হানা দেয়নি ব্রাজিল–‌আর্জেন্টিনা। বাঙালি তখনও দু’‌ভাগ হয়ে যায়নি এই দুই মহাশক্তিকে ঘিরে। বাঙালি তখনও মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গলের লড়াই নিয়েই মেতে আছে। এমন সময় হঠাৎ খবর এল, কলকাতায় পেলে আসছেন। ইডেন উদ্যানে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে তিনি একটি প্রীতি ম্যাচে খেলবেন।

ততদিনে পেলের চারবার বিশ্বকাপে খেলা হয়ে গেছে। ততদিনে তিনবার বিশ্বজয়ের মুকুট মাথায় উঠে গেছে। যদিও আন্তর্জাতিক ফুটবলকে তার অনেক আগেই বিদায় জানিয়েছেন। তিনি তখন খেলেন নিউইয়র্ক কসমসের হয়ে। আমেরিকায় ফুটবলের বিস্তার ঘটানোর লক্ষ্যেই তাঁকে সেই দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বয়স তখন ৩৭। আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে দূরে সরে থাকলেও হাজার হোক, তিনি পেলে। বিশ্ব ফুটবলের মুকুটহীন সম্রাট। সেই পেলে আসছেন শুনে উন্মাদনা তৈরি হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।

তখন কলকাতায় টেলিভিশন এলেও তা মূলত উচ্চবিত্ত বাড়িতেই শোভাবর্ধন করত। টিভিতে আন্তর্জাতিক ফুটবল তখনও সেভাবে দেখানো শুরু হয়নি। খবরের কাগজেও আন্তর্জাতিক ফুটবল নিয়ে বিরাট কিছু লেখালেখির চল ছিল না। ফলে, পেলে ছিলেন অনেকটাই দূরগ্রহের তারকা। এমন একজন তারকাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ। ফুটবলপ্রেমী জনতার কাছে যেন স্বপ্নপূরণের হাতছানি।

শুরুতে একটা সংশয়ও ছিল। সত্যিই তিনি আসবেন তো?‌ একটা সময় সেই সংশয়ের মেঘ কাটল। জানা গেল, সত্যিই তিনি আসছেন। দিনটা ছিল ১৯৭৭ এর ২২ সেপ্টেম্বর। ব্যাঙ্কক থেকে কসমস দলকে নিয়ে সেই বিমান নামল রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ। এত রাতেও দমদম বিমানবন্দরের বাইরে কাতারে কাতারে মানুষ। সবাই একটি বারের জন্য দেখতে চান ফুটবল সম্রাটকে। বিমান নামতেই জনতার গর্জন, পে.‌.‌লে–‌পে.‌.‌লে। ফ্লাডলাইটের আলোয় ফুটবল সম্রাট এসে দাঁড়ালেন বিমানের সিঁড়িতে। পাশে স্ত্রী। পেছনে নিউইয়র্ক কসমসের সতীর্থরা। পেলের পরনে খয়েরি রঙের স্যুট, ঘি রঙের টাই। হাতের দু’‌আঙুল তুলে ‘‌ভি’‌ চিহ্ন দেখালেন।

বাইরে নিরাপত্তার বেশ কড়াকড়ি। কিন্তু এই উত্তাল জনতাকে কে ঠেকাবে! পুলিশের কর্ডন ভেঙে ঢুকে পড়ল জনতা। তাঁকে ঘিরে গভীর রাতে এমন উন্মাদনা হবে, ফুটবল সম্রাট ভাবতেও পারেননি। এত ভিড় দেখে আর নামলেন না। ফের বিমানে ঢুকে পড়লেন। বিমানের ভেতরে গিয়েই তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী, মোহনবাগান সভাপতি ধীরেন দে। ছিলেন শৈলেন মান্না, চুনী গোস্বামীরাও। অনেক কষ্টে তাঁকে বের করা হল বিমানবন্দর থেকে। এত রাতেও রাস্তার দু’‌ধারে লোকে লোকারণ্য। যেন নবমীর রাত। খোলা জিপে তোলা হল পেলেকে। দু’‌ধারে জনতার দিকে তিনি হাত নাড়তে লাগলেন। আনা হল গ্র‌্যান্ড হোটেলে। মধ্যরাতে একেবারে ভারতীয় রীতি মেনে অভ্যর্থনা জানানো হল কিংবদন্তি ফুটবলারকে।

ফুটবল সম্রাট এলেন ঠিকই। কিন্তু তখনও সংশয় দূর হল না। কারণ, পরদিন বৃষ্টি হয়েছে। ইডেনের মাঠ ভিজে। এই ভারী মাঠে চোট পাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তিনি আদৌ মাঠে নামবেন তো?‌ তিনি যেন মাঠে না নামেন, ইন্সিওরেন্স কোম্পানির নিষেধাজ্ঞাও ছিল। কিন্তু পেলে সাফ জানিয়ে দিলেন, এত এত মানুষ আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, এত মানুষ মাঠে আসবেন, আমি খেলব।

অবশেষে এল সেই ২৪ সেপ্টেম্বর। কলকাতা ফুটবলে এক ঐতিহাসিক দিন। কসমসের বিরুদ্ধে খেলতে নামল মোহনবাগান। মোহনবাগান সভাপতি ধীরেন দে অনেক আগেই ফুটবলারদের সতর্ক করেছিলেন, ‘‌তোমাদের হাতে ক্লাবের মান সম্মান। চার–‌পাঁচ গোল পর্যন্ত ঠিক আছে। দেখো, দশ–‌বারো গোল খেয়ে বোসো না।’‌ কোচ পিকে ব্যানার্জিও কদিন ধরেই অঙ্ক কষছেন, কীভাবে আটকানো যায় ফুটবল সম্রাটকে। সুব্রত ভট্টাচার্য, প্রসূন ব্যানার্জি, গৌতম সরকার, মহম্মদ হাবিব, শ্যাম থাপা, বিদেশ বসু, শিবাজী ব্যানার্জিরাও তৈরি, এই ম্যাচে কিছু একটা করে দেখাতেই হবে। নিজেদের ছাপিয়ে যেতে হবে।

এদিকে, টিকিটের জন্য হাহাকার। মাঠে অন্তত সত্তর হাজার দর্শক। টিকিট না পেয়ে বাইরেও অন্তত হাজার কুড়ি দর্শক। সেই তালিকায় শুধু মোহনবাগান সমর্থকরা ছিলেন, এমন নয়। ইস্টবেঙ্গলের হাজার হাজার জনতাও সেদিন ভীড় করেছিলেন পেলেকে একবার দেখার জন্য। খেলা শুরুর আগে দুই দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচিত হলেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। শুরুতেই কসমস এগিয়ে গেল। শ্যাম থাপা সেই গোল শোধও করে দিলেন। একটা সময় মহম্মদ হাবিবের গোলে মোহনবাগান এগিয়েও গেল। যদিও পরে কসমস সেই গোল শোধ করে দেয়। পেলে যখনই বল ধরেছেন, গ্যালারি উত্তাল হয়ে উঠেছে। অনেকেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না কাকে সমর্থন জানাবেন, পেলের কসমসকে?‌ নাকি ঘরের দল মোহনবাগানকে?‌ একদিকে পেলেকে দেখার উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে ঘরের ছেলেদের দুরন্ত লড়াই। দুটোই সেদিন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছিল ইডেনের গ্যালারি।

ম্যাচের পর মোহনবাগানের দুরন্ত লড়াইয়ের প্রশংসা করেছিলেন ফুটবল সম্রাট। বলেছিলেন, মোহনবাগান এমন ফুটবল খেলবে, তিনি ভাবতে পারেননি। আর কলকাতার ফুটবলপ্রেমী জনতা যেভাবে তাঁকে বরণ করে নিয়েছিল, বহু বছর পরেও তা মনে ছিল ফুটবল সম্রাটের। কলকাতাও সযত্নে আগলে রেখেছে সেই স্মৃতি। তাই সম্রাটের বিদায়বেলায় স্বজনহারানোর যন্ত্রণা যেন তাড়া করছে কল্লোলিনী তিলোত্তমাকেও।

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.