কপালেই কালেকশন
অর্কজ্যোতি মজুমদার
শ্যামলী এখন ঠিক আছে। কপালে চারটে সেলাই পড়েছে। সন্টুদা, যিনি মানুষের জন্যে কাজ করেন, স্থানীয় সমাজসেবা করেন এমন এক রাজনৈতিক দাদা। সেই দাদার বউ শ্যামলী। ডাক্তার বলেছেন অ্যাডমিশনের কোনও প্রয়োজন নেই। তবু সেই দাদা বৌদিকে আজ এখন বা আগামীকাল বাড়ি নিয়ে যেতে কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না, মানুষের কাজ করতে চাওয়া দাদা। ডাক্তারবাবুকে বলছেন- তিন চার দিন নার্সিংহোমে থাকুক। দাদা বলেছেন মানে ডাক্তারবাবু- নার্সিংহোম মহা আনন্দে রাজি হয়ে যাবেন।
সন্টুদা’র ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক মায়ায় বেড়ে ওঠা বাচ্চা ছেলেগুলো বেরিয়ে পড়েছে ‘দাদা’র বউ নার্সিংহোমে ভর্তি। সে কি হেলাফেলা করার বিষয়? এই নার্সিংহোমে দাদা অনেকবার সমাজসেবা করে গেছেন। ফিতে কাটা, মোমবাতি জ্বালানো, মাঝে মধ্যে রোগী পাঠানো, শত ব্যস্ততার মধ্যেও এই সেবা দিয়ে গেছেন দাদা। সেই খাতিরে হয়তো নার্সিংহোম টাকা নাও নিতে পারে। রাজনৈতিক মায়ায় বেড়ে ওঠা, মানুষের সেবায় ব্রতী এক মায়াবী দুষ্টু ছেলে, সে কিছুই জানে না। সে অন্যদেরকে জিজ্ঞেস করে —
কী হয়েছে?
তখন সব কিছু তাকে বলা হচ্ছে,
— দাদা গত এক সপ্তাহ ধরে একশ আটটা জবা ফুল দিয়ে গাঁথা মালা তিনটে করে দিচ্ছিল ঘরের ঠাকুরকে। গেল শনিবার শনি ঠাকুরের নামে সারাদিন উপবাস করে, রাতে শুধুমাত্র সিন্নি খেয়ে শুয়েছিল। সেদিন দাদা মদ্যপান পর্যন্ত করেনি। দাদার জন্যে এটা একটা মহান ত্যাগ। সারাক্ষণ মোবাইলে খবর দেখেই যাচ্ছিল।
—তার সাথে বৌদির মাথা ফাটার সম্পর্ক কী?
—আবে! পুরোটা শুনবি তো, মাঝখান থেকে ক্যালানের মতো টপকাস কেন?
— আচ্ছা আচ্ছা বল ভাই।
— এদিকে বৌদি একশো আটটা জবা ফুল দিয়ে গাঁথা মালা চারটে করে ঘরের ঠাকুরকে দিয়েছে এ ক’দিন।
— দুজনে মিলে এত মালা? ঘরের ঠাকুর কত বড়? কত টাকার ফুল?
— আবে! আবার মাঝখানে টপকেছিস?
— আচ্ছা বল।
— ঠাকুর যাই হোক, এক ফুলমাসীকে বাজারে বড় দোকানের সামনে বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে দাদা, ওখান থেকে হপ্তার টাকা তোলে না, বিনিময়ে দাদার ঘরের সব ফুল বিনামূল্যে দিতে হয়।
— আমাদের দাদা বেশ তালেগোলে মোটামুটি সব ভোগই ফ্রি করে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে।
— তুই যেন আবে প্রথম দেখছিস?
— গতকাল বিকেলে আমাদেরকে নিয়ে দাদা গেছিল ওই বিলের ধারে, রেল লাইনের ধারে, শীতলাতলা বস্তির ঘরে ঘরে সব জায়গায়। আমরা গুনেও এসেছি কোন বাড়ির অবস্থা কেমন? কোনটা ভাঙতে পারে, কত সদস্য? আমরা সব লিখেও এনেছি।
— আমি কিছু বুঝতে পারছি না, এর সঙ্গে বৌদির মাথা ফাটার সম্পর্ক কী?
— এসব বুঝতে গেলে মানুষের জন্যে কিছু কাজ করার ইচ্ছে থাকতে হয়, সমাজসেবা করতে জানতে হয়। দাদা বলছিল এবারে ব্যাঙ্কের সব দেনা মিটিয়ে দেবে। একটা নতুন গাড়ি নেবে, বুঝলি, কিছু জমিও কিনে রাখবে।
— তারপর হঠাৎ কী হল?
— আজ সকালে দাদা চা নিয়ে ঘরের টেলিভিশনের সামনে বসে খবর দেখছিল। খবরে দেখাচ্ছে ঝড় দাদার অঞ্চলের দিকে আসছে না।
দাদার সামনেই বৌদি সারাক্ষণ ঠাকুরকে এই ক’দিন ধরে বলছিল ঝড়টা যেন না হয়, কত মানুষের ক্ষতি হয়।
লেটেস্ট আবহাওয়ার খবর দেখে দাদার মাথায় রক্ত উঠে যায়, রেগে লাল হয়ে ওঠে, রাগের চোটে হাত কামড়াতে কামড়াতে বিড়বিড় করছিল এবার মানুষের জন্যে কিছু করা যাবে না? হাতের সামনে একটা পেপার ওয়েট ছিল, সপাটে ছুঁড়েছে দেওয়ালে। বৌদি রান্নাঘর থেকে আসছিল, ব্যাস, সোজা বৌদির কপালে। তারপরেই আমাদেরকে ডাকল, আমরা গেলাম।
—আমাকে ডাকলি না কেন?
— মনে ছিল না। দাদা একটা দারুন দারুন কথা বলেছে বুঝলি? কথাটা মনে রাখিস ……
— কী কথা?
— বলেছে ঝড় আমার আয়ে বাঁধা দিতে পারে, কিন্তু বৌদির কপালেই আমার কালেকশন লেখা ছিল।
আমরা সবাই দাদার কাছে পৌঁছে গেছি, দাদা বললেন, কালেকশনটা ঠিক করে করিস সবাই, বৌদি নার্সিংহোমে ভর্তির গল্প শুনিয়ে। দেখিস তোরা যেন কালেকশন থেকে বেশি করে কাটমানির নামে ঝেড়ে দিস না, দাদা কালেকশন করতে অনেক পরিশ্রম হয়েছে, আমাদের কমিশনের কাটমানিটা একটু বাড়িয়ে দাও বলে আব্দার করে বসিস না। সব বাচ্চা দুষ্টু ছেলের দল, যা বেরিয়ে পড় এখনই। দুগ্গা দুগ্গা……….