অরূপ ঘোষ
—অরূপ! এই অরূপ! ওঠ! দেখ মেঘ কেটে গেছে! চাঁদ দেখা যাচ্ছে!
— ফালতু বাওয়াল করিস না পুটু। ঘুমা, আর আমাকেও ঘুমাতে দে। চোখ না খুলেই ব্ল্যাঙ্কেটটাকে আরেকটু ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নিলাম।
— আরে ভাই বাইরে চল, দেখে আসি।
— তুই যা, দেখে এসে আমাকে ডাকিস। ব্ল্যাঙ্কেটে ভালো করে প্যাকিং হয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম।
আর তার ঠিক এক মিনিট পর আমাদের ঘরটায় একটা ঝড় উঠল। ঝড়টা তুলল প্রণবেশ।
—গোটা ঘরে ছুটছে আর সবাইকে ডেকে ডেকে তুলছে, ওঠো! ওঠো! সবাই ওঠো কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে! স্লিপিং বুদ্ধ দেখা যাচ্ছে! অরূপ রে ওঠ, সঙ্গীতদা ওঠো ওঠো! অনিন্দাদি ওঠো! সৌম্য ভাই ওঠরে! বাইরে দেখবি চল!
প্রণবেশের চেঁচামেচিতে ততক্ষণে সবারই কাঁচা ঘুম ভেঙে গিয়েছে! কয়েকজন যা শুনেছে তা বিশ্বাস করতে পারছে না, আর কয়েকজন প্রণবেশ কী বলছে, তা শুনতে পেলেও বুঝতে পারছে না। আসলে যা ঠাণ্ডা, তাতে মাথাও কাজ করতে সময় নিচ্ছে।
জ্যাকেট টুপি পরে যখন বাইরে আসছিলাম, করিডরটার শেষ থেকে ওপাশে কাঁচের দরজা দিয়ে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। অদ্ভূত তার রং, বুকের মধ্যে রোমাঞ্চ, ভয় সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত অনুভূতি। তারপর বাইরে এসে দাঁড়ালাম। ছবিতে, ভিডিওতে অজস্রবার দেখেছি। কিন্ত নিজের চোখে প্রথমবার তাকে দেখার, বিশেষ করে চাঁদের আলোয় তাকে দেখার সেই অনুভূতি যে কেমন, যে দেখেনি তাকে বোঝানো যাবে না।
প্রথমদিকে তো বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম। যখন হুঁশ ফিরল, তখন বুঝতে পারছি, পায়ের আর হাতের আঙুলগুলো ঠান্ডায় ব্যথা করছে। তাড়াহুড়োয় জুতোটাও পরিনি, হাওয়াই চটি পরেই বেরিয়ে এসেছিলাম। এক একবার মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ দেখলাম, এবার যাই জুতোটা অন্তত পরে আসি। কিন্তু একটা অমোঘ আকর্ষণ ওখানেই দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। কিছুতেই ভেতরে যেতে দিচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল ভেতর থেকে ফিরে এসে যদি না দেখতে পাই। ওই রাত দেড়টার সময় যেন গোটা সান্দাকফু জেগে উঠেছে। আমাদের হোটেলের বাইরে, ওপরের ছাদে ওই ঠান্ডার মধ্যেও সকলে দাঁড়িয়ে।
বাংলায় বেশ সুন্দর একটা শব্দ আছে — চন্দ্রাহত। সেদিন কোজাগরি পূর্ণিমার ওই রাত্রে সান্দাকফুতে যাঁরা হাজির ছিলেন, তাঁরা সকলেই যেন চন্দ্রাহত হয়ে গিয়েছেন। শায়িত বুদ্ধ যিনি এই বিশাল হিমালয়কে, আকাশের নয় লক্ষ তারাকে, হিমালয়ের কোলে আমাদের সবাইকে রক্ষা করে চলেছেন, তিনি চাঁদের আলোয় আমাদের সামনে শুয়ে আছেন। শুয়ে আছেন নিশ্চল নিশ্চুপ মৌন অথচ কী ভীষণ জীবন্ত! কী সৌম্য তার রূপ। এভাবেই যুগের পর যুগ তিনি এভাবে শুয়ে আছেন, শুয়ে থাকবেন। আমাদের রক্ষা করে যাবেন, আমাদের মোহিত করবেন, আমাদের বুকে সম্ভ্রম জাগিয়ে তুলবেন। বার বার মনে করিয়ে দেবেন আমরা কত ক্ষুদ্র, কত তুচ্ছ।
ঘোর কাটার পর একটা কথাই মনে মনে উচ্চারিত হয়েছে, ‘হে শায়িত বুদ্ধ, আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম গ্রহণ করুন।’