‌কথামৃতর ইতিকথা

কুন্তল আচার্য

চাটুজ্যে বামুনের বদ্যি পাবলিসিটি অফিসার। তখনকার দিনে বেশ চালু একটা কথা। এই চাটুজ্যে বামুনই বা কে?‌ আর বদ্যি পাবলিসিটি অফিসারটিই বা কে?‌ প্রথমজন গদাধর চ্যাটার্জি। যাঁকে বাঙালি শ্রীরামকৃষ্ণ নামে চেনে। আর দ্বিতীয়জন মহেন্দ্র গুপ্ত। পেশায় শিক্ষক। পরবর্তীকালে শ্রীম নামে পরিচিত। তাঁকে কি লেখক বলা যায়!‌ যদিও তিনি নিজে নিজেকে কখনও লেখক বলে মনে করতেন না। কিন্তু একটু একটু করে বাংলা ভাষার একটি আকর গ্রন্থ লিখে ফেলেছেন। বইয়ের নাম?‌ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত।

সারা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে আছে রামকৃষ্ণ মিশনের শাখা। কত হাজার হাজার সন্ন্যাসী ছড়িয়ে আছেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে। এতকিছুর পরেও রামকৃষ্ণ আমাদের কাছে অনেকটাই অধরা থেকে যেতেন যদি এই মহেন্দ্র গুপ্ত না থাকতেন। রামকৃষ্ণ বিচিত্র সব নামে তাঁকে ডাকতেন। কখনও বলতেন মাস্টার, কখনও হেডমাস্টার। কখনও বলতেন ইংলিশম্যান, আবার কখনও মহেন্দ্র মাস্টার। এই মাস্টারের দীর্ঘ প্রচেষ্টাতেই বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে গেলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।

অনেকে বলতেই পারেন বিবেকানন্দের কথা। কিন্তু রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর এই বিবেকানন্দের বড় একটা সময় কেটেছে ভারত ভ্রমণ ও বিশ্ব ভ্রমণে। ফিরে আসার পরেও সেভাবে রামকৃষ্ণের কথা প্রচার করার সুযোগ পেলেন কই? বড্ড তাড়াতাড়িই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন। তাছাড়া,‌ তিনি নিজেই এক জ্বলন্ত সূর্য। নিজেই কিংবদন্তি। বেদ–‌বেদান্ত থেকে শুরু করে ধর্ম–‌পুরাণ নানা ব্যাপারে তাঁর ব্যাখ্যা শোনার জন্যই বসে থাকতেন ভক্তরা। কিন্তু মহেন্দ্র গুপ্ত নিজে সেলিব্রিটি ছিলেন না। ফলে, তিনি এক মুগ্ধ ভক্তের মতোই অনন্ত সময় ধরে রামকৃষ্ণকে কাছ থেকে দেখে গেছেন। বাড়ি ফিরে সেইসব কাহিনি লিখে গেছেন। লিখতে লিখতে কখনও রাত পেরিয়ে ভোরও হয়ে গেছে। ডায়েরিতে লিখে রাখা সেইসব ঘটনা কখনও বই হয়ে বেরোবে, লোকের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে, এমনটা তাঁর সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না।

এই মহেন্দ্র গুপ্ত আসলে বিবেকানন্দের শিক্ষক। বিবেকানন্দও তাঁকে মাস্টারমশাই বলেই ডাকতেন। পিতৃবিয়োগের পর অর্থাভাবে বিবেকানন্দ তখন দিশেহারা। হেডমাস্টার মহেন্দ্র গুপ্তই তাঁকে চাকরি দিয়েছিলেন মেট্রোপলিটন স্কুলে। সেটি ছিল বিদ্যাসাগরের তৈরি করা স্কুল। বিদ্যাসাগর তৈরি করলেও স্কুলের সেক্রেটারি ছিলেন তাঁর জামাই। দৈনন্দিন কাজ সেই জামাই বাবাজীবনই দেখাশোনা করতেন। তাঁর আবার নরেনকে নানা কারণে ভাল লাগত না। ফলে, এই চাকরি বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারেননি নরেন। অবশ্য মাস্টারমশাইও বেশিদিন সেই স্কুলে রইলেন না। একসময় বিদ্যাসাগরের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় তিনিও মেট্রোপলিটন স্কুল ছেড়েই দিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ?‌ তিনি নাকি মন দিয়ে স্কুল করছেন না। মাঝে মাঝেই রামকৃষ্ণের কাছে চলে যাচ্ছেন। সেই চাকরি ছেড়ে যখন রামকৃষ্ণের কাছে এলেন, রামকৃষ্ণ বলে বসলেন, বেশ করেছো, বেশ করেছো, বেশ করেছো।

কিন্তু এদিকে অর্থাভাব বেড়ে চলেছে মাস্টারমশাইয়ের। স্কুল থেকে এবার কাজ নিলেন কলেজে। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি প্রতিষ্ঠিত রিপন কলেজে। পরে চাকরি নিয়েছিলেন সিটি কলেজেও। পড়াতেন ইংরাজি, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস। একসময় একসঙ্গে তিনটি স্কুলে কাজ করেছেন। তিনটি স্কুলের উপার্জন খরচ করতেন তিনটি খাতে। একটি স্কুলের টাকা যেত বরাহনগরের মঠে, গুরুভাইদের সেবায়। একটি স্কুলের টাকা দান করতেন সারদামণি ও সন্ন্যাসীদের জন্য। আরেকটি স্কুলের টাকা খরচ হত নিজের সংসারের কাজে।

এবার কথামৃতে আসা যাক। রামকৃষ্ণের সঙ্গে মহেন্দ্রবাবুর আলাপ ১৮৮২–‌র ফেব্রুয়ারি নাগাদ। রামকৃষ্ণের মৃত্যু হয় ১৮৮৬–‌র আগস্টে। অর্থাৎ, এই সাড়ে চার বছর রামকৃষ্ণের নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছেন। বয়সে তিনি রামকৃষ্ণের থেকে ১৮ বছরের ছোট। সময় হলেই চলে যেতেন দক্ষিণেশ্বরে। সবকিছু খুঁটিয়ে শুনতেন। সবসময় যে রামকৃষ্ণ তাঁর সঙ্গে খোশগল্প করতেন, এমন নয়। নানাপ্রান্ত থেকে ভক্তরা আসতেন। সেই তালিকায় তখনকার সমাজের দিকপালরাও ছিলেন। তাঁরা রামকৃষ্ণকে কী বলছেন, রামকৃষ্ণ তাঁদের কী বলছেন, সব খেয়াল রাখতেন। রাতে বাড়ি ফিরে বসে যেতেন ডায়েরি লিখতে। সবকিছু খুঁটিয়ে লিখে রাখতেন। এমনকী লিখতে লিখতে কখনও সকাল হয়ে যেত। অনেক সময় অনেককিছু হয়ত মনে পড়ছে না। মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অস্থিরতা। বারবার মনে করার চেষ্টা করতেন। হয়ত ঘুমের মাঝেই মনে পড়ল। অমনি উঠে পড়ে লিখে নিতেন।

কিন্তু হঠাৎ এই ডায়েরি লেখার ইচ্ছে হল কেন?‌ নিজেই জানিয়েছেন, ছোট বেলায় পড়েছিলেন চৈতন্য চরিতামৃত। আবার ডায়েরি লেখার অভ্যেসটাও সেই ছোটবেলার। শুরুতে নিজের কথাই লিখতেন। বন্ধুদের কথা লিখতেন। বাড়ির লোকের কথা লিখতেন। কিন্তু রামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাতের পরই মনের ভেতর আমূল এক পরিবর্তন এল। মনে হল, এই মানুষটার কথাগুলো যদি লিখে রাখতে পারি!‌ এভাবেই একটু একটু করে লেখার শুরু। কথামৃতের প্রাণপুরুষ বারবার জানিয়েছেন, কারও জন্য নয়, এই লেখা লিখেছিলাম শুধু নিজের জন্যই। লিখে আনন্দ পেতাম। এটাই ছিল পরম প্রাপ্তি।

এই লেখাকে তিনি যে জনসমক্ষে আনতে চাননি, তা নানা ঘটনা পরম্পরা থেকেই বোঝা যায়। কারণ, রামকৃষ্ণের মৃত্যুর অন্তত ষোল বছর পর বেরিয়েছে প্রথম খণ্ড। যদি সত্যিই আত্মপ্রচারের জন্য লিখতেন, তাহলে ষোল বছর অপেক্ষা করতেন না। পরের বছরই লিখে ফেলতেন। আসলে, রামকৃষ্ণের মৃত্যুর এগারো বছর পর তাঁকে নিয়ে ইংরাজিতে একটি পুস্তিকা বেরোলো। তখন অনেকে তাঁকেও পরামর্শ দিলেন লেখাগুলো একটু একটু করে সামনে আনতে। কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের বেশ কুণ্ঠাই ছিল। তিনি ডায়েরি নিয়ে গিয়ে পড়ালেন সারদা মা–‌কে। সারদামণি দরাজ প্রশংসা করলেন। বললেন, তোমার লেখা পড়ে মনে হচ্ছে, উনি নিজেই কথা বলছেন। সারদা তখন বেশিরভাগ সময় থাকতেন জয়রামবাটিতে। সেখানেও গুরু মায়ের কাছে ছুটে গেছেন মহেন্দ্র গুপ্ত। সারদার কাছ থেকে সাহস পেয়ে মনে হল, এবার এই ডায়েরির কিছু অংশ পাঠকের সামনে উন্মুক্ত করা যায়।

বিক্ষিপ্তভাবে বঙ্গদর্শন, উদ্বোধন, হিন্দু পত্রিকা, জন্মভূমিতে বেরিয়েছে। প্রথমে নাম ছিল শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ লীলামৃত। পরে নাম হল শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কথা। তারপর ১৮৯৯ নাগাদ নাম হল শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃতম। সেখান থেকে নাম হল শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত। প্রথম বই হয়ে বেরোলো ১৯০২ সাল নাগাদ। সেই বছরই মৃত্যু হল স্বামী বিবেকানন্দের। স্বয়ং রামকৃষ্ণর জীবন নিয়ে বই লেখা হবে, অথচ কোনও প্রকাশক পাননি কথামৃতের লেখক। নিজের টাকা থেকেই বই বের করেছেন। পরের খণ্ডগুলি বেরিয়েছে ১৯০৪, ১৯০৮, ১৯১০ নাগাদ। এই চারটি খণ্ড লেখার পর ২২ বছরের বিরতি। এর মাঝে একের পর এক ঝড়ঝাপটা এসেছে তাঁর জীবনেও। শরীরও ভেঙে পড়েছিল। আর লিখতে পারবেন কিনা, নিজের ভেতরেই সংশয় ছিল। এদিকে, তাঁর লেখা চার খণ্ড বই তখন ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। অবশেষে, পঞ্চম খণ্ড দিনের আলো দেখল ১৯৩২ নাগাদ। সেই পঞ্চম খণ্ড ছাপার অক্ষরে, বই আকারে দেখে যেতে পারেননি। যেদিন তাঁর মৃত্যু হয়, তার আগের রাতে দেখেছেন পঞ্চম খণ্ডের ফাইনাল প্রুফ।

শোনা যায়, আরও দু’‌খণ্ড লেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আর হয়ে উঠল না। ডায়েরি থেকে জানা যাচ্ছে, দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে ৭১ বার। বইয়ে ২৫৫ জন ভক্ত ও আগন্তুকের কথা আছে। সেই তালিকায় সেই যুগের দিকপাল লোকেরাও ছিলেন। সাল, তারিখ ধরে ধরে পুঙ্খানুপুঙ্খ লিখে গেছেন। এমনই ঝরঝরে ভাষা, যে কেউ বুঝতে পারবেন। সহজবোধ্য ভাষার কারণেই বইগুলি ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে।

একটি সূর্যের আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে কত প্রান্তে। একটা জীবনের চারপাশে আরও কত জীবন। আড়ালেই থেকে যান মহেন্দ্র গুপ্তরা। আড়াল থেকে তাঁরা আলো দেখান। সেই আলোয় আরও স্পষ্ট দেখা যায় পরমহংসদেবকে। ‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.