বিতাড়িত ন্যানোর আত্মকথা
স্বরূপ গোস্বামী
এটাই হয়। কাজের সময় কাজি। কাজ ফুরোলেই পাজি। একসময় আমাকে নিয়ে কত হইচই। আমাকে নিয়ে চ্যানেলে সারাক্ষণ আলোচনা। আমাকে নিয়ে কাগজের প্রথম পাতা। যেই সময়ের ধুলো পড়ল, অমনি সবাই বেমালুম ভুলে গেল। না বাম, না ডান, না রাম–কেউ আমার নামই উচ্চারণ করত না।
যাক, আবার আমি ফিরে এলাম। আপনারা যতই কুৎসা করুন, আমি বাপু দিদিমণির কাছে কৃতজ্ঞ। তিনিই তো আমাকে কবর থেকে তুলে আনলেন। তাই তো আপনারা আবার পুরনো খবরের কাগজের কাটিং খুঁজে বের করছেন। তাই তো আবার টিভির সান্ধ্য আসরে হইচই চলছে। তাই তো আবার ফেসবুকে চুকলি কাটা চলছে।
ফিরে চলুন, চোদ্দ–পনেরো বছর আগে। আমাকে নিয়ে, মানে ন্যানোকে নিয়ে রাজ্য তখন উত্তাল। একদিকে মহাকরণে তখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তিনি বাংলার তরুণদের চোখে নতুন স্বপ্ন এঁকে দিচ্ছেন। জোর দিয়েছেন কর্ম সংস্থানে। এখান–ওখান ছুটে যাচ্ছেন। শিল্পপতিদের বোঝাচ্ছেন, বাংলায় বিনিয়োগ করুন। বারবার বলছেন, এত এত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। এত এত আইটিআই কলেজ। এখান থেকে বেরিয়ে এসে ছেলেরা যাবে কোথায়? তারা কেন ভিনরাজ্যে যাবে? এই রাজ্যেই তাদের কাজ দিতে হবে। কলকারখানা স্থাপন করতে হবে। শিল্পে আমাদের ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। কৃষি আমাদের ভিত্তি। শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ। শিল্পের দিকে আমাদের এগোতেই হবে।
অন্যদিকে, কুচুটে বামপন্থীদের দল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তো অনশনে বসে গেলেন। কিছুতেই তিনি জমি অধিগ্রহণ করতে দেবেন না। কিছুতেই তিনি কারখানা হতে দেবেন না। কেনারাম–বেচারামদের নিয়ে চলে গেলেন সিঙ্গুরে। মাচা করে বসলেন। হাইওয়ে দিনের পর দিন অবরোধ করে রাখলেন। কত নকশাল, মাওবাদি, হাফ নকশাল, কাকতাড়ুয়া শিল্পী জুটে গেল ওই বুদ্ধবাবুর সঙ্গে। তাঁরা বলেই চলেছেন, কোনও ভাবেই জমি নেওয়া চলবে না। কীসের অনুসারী শিল্প? ওখানে শিল্প হবে না ছাই হবে। সব টাটাকে জমি দেওয়ার ফন্দি। একটা কারখানা করতে কত জমি লাগে? আমাকে শিল্প শেখাতে আসবেন না। ওখানে শপিং মল হবে, পানশালা হবে, বিউটি পার্লার হবে, আরও কী সব যেন হবে। মোদ্দা কথা, জমি নেওয়া চলবে না। জমি নিতে গেলে রক্তগঙ্গা বইবে।
আমাদের দিদিমণি খুবই সহিষ্ণু। তিনি বিরোধীদের মর্যাদা দেন। তাই বৈঠক ডাকলেন। একবার তথ্যকেন্দ্রে। একবার রাজভবনে। বুদ্ধবাবুকে বারবার তিনি বোঝালেন, আমাদের বিরুদ্ধে যত খুশি আন্দোলন করুন। কিন্তু প্লিজ, কারখানাটা হতে দিন। এত এত বেকার ছেলের কর্মসংস্থানের সুযোগ নষ্ট করবেন না। এই কারখানা হলে এলাকার চেহারা পাল্টে যাবে। একটা কারখানা হলে তার হাত ধরে আরও কয়েকশো কারখানা তৈরি হবে। ইতিহাস এই সুযোগ বারবার দেয় না। প্লিজ, রাজি হয়ে যান।
কিন্তু গোঁয়ার বুদ্ধবাবু এসব শুনলে তো! প্রথম থেকেই গোঁ ধরে বসে আছেন, আমার চারশো একর চাই। ওই চারশো একর ছাড়া তিনি কিছুই বোঝেন না। আলোচনা হল, সব ভেস্তে গেল। তিনি কিছুতেই কারখানা হতে দেবেন না। শুধু কি বুদ্ধবাবু! বিমান বসু, নিরুপম সেন, গৌতম দেব— সবাই পাজি। তারা জেদ ধরেই রইল— কিছুতেই কারখানা হতে দেব না। অনিচ্ছুকদের জমি ফেরত দিতেই হবে। সিঙ্গুরে কেন কারখানা হবে? কত ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে। সেখানে হোক। তাছাড়া, শিল্প করতে এত জমি কেন লাগবে?
বেচারা রতন টাটা। কত আশা ছিল, ন্যানো গাড়ির কারখানা করবেন। মানুষকে একলাখ টাকায় গাড়ি দেবেন। অটো মোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে বিপ্লব আনবেন। দিদিমণির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। শিল্পকে নিয়ে দিদিমণির কত স্বপ্ন, কত আন্তরিকতা। টাটাবাবুরা বুঝেছিলেন।
কিন্তু ওই যে খুনি বুদ্ধবাবু। কুচুটে সিপিএম। তারা বুঝতেই চাইল না। তারা টাটাকে তাড়িয়েই ছাড়ল। রতন টাটা তো যাওয়ার সময় বলেই গেলেন, সিপিএমের জন্যই শিল্প করতে পারলাম না। তাদের জন্যই আমাকে এই রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। বলেছিলাম, মাথায় বন্দুক ঠেকালেও কারখানা করব। কিন্তু বুদ্ধবাবু তো ট্রিগার টিপে দিলেন।
মাত্র চোদ্দ বছরে সবাই কেমন বেমালুম ভুলে গেল। শুধু শুধুই দিদিমণিকে দায়ী করে। সত্যিই তো, তাঁর কোনও দোষই ছিল না। তিনি তো চেয়েছিলেন টাটার কারখানা হোক। যত পাজি ওই সিপিএম। তারাই টাটাকে তাড়িয়ে ছাড়ল।
কী বলছেন? আমি ভুল বকছি? আমি ইতিহাস বিকৃত করছি? আমি মিথ্যে বলছি? ধুর মশাই, আপনারা কিছুই জানেন না। যান, আগে ‘নিরলস সাহিত্যসাধনা’ করে আসুন। রাজ্যে এত বিনিয়োগ হচ্ছে, এত কলকারখানা হচ্ছে, আপনারা বুঝতেও পারছেন না। প্রাইমারি, এসএসসি, সিএসসি–র মাধ্যমে স্বচ্ছভাবে এত শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে, আপনারা জানতেও পারছেন না।
আসলে, আপনারা যেগুলো শুনে এসেছেন, দেখে এসেছেন, সেগুলোই গিলতে থাকেন। হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতা কত বছর পর আবিস্কার হয়েছিল। ইতিহাস এভাবেই চাপা পড়ে থাকে। কতকাল পরে কোনও এক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় গিয়ে কিনা আবিস্কার করলেন। মনে রাখবেন, ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’দের একটা আলাদা প্রতিভা থাকে। সিঙ্গুরের ধ্বংসাবশেষ দেখে, শিল্পের ডিএনএ টেস্ট করে আসল সত্যিটা তিনি ঠিক বের করে এনেছেন। এর জন্য পোতিভা লাগে মশাই, পোতিভা।
আপনি কি ভাবছেন আমি বিভূতিভূষণ, মানিক বা তারাশঙ্কর— এই তিনি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলছি? বা, তারও আগে বিদ্যাসাগর উপাধি পাওয়া বাঁড়ুজ্যের কথা বলছি? ওঁরা বাংলার জন্য কী করেছেন? ভুলেও ওঁদের ‘বাংলার গর্ব’ বলতে যাবেন না। ‘বাংলার গর্ব’ একজনই। এই কৃতিত্বের কোনও ভাগ হবে না।
আর কথা বাড়িয়ে কাজ নেই। আপনারাও অনুপ্রাণিত হোন। মেনে নিন, টাটাকে সিপিএমই তাড়িয়েছে।