সরল বিশ্বাস
প্রথমেই দ্বিধাহীনভাবে জানিয়ে রাখি, আমি একজন বাম অনুরাগী। বামেদের সব কিছুর সঙ্গে যে সহমত পোষণ করি, এমন নয়। অনেক পদক্ষেপ নিয়ে তীব্র আপত্তিও থাকে। যেহেতু আমি দলীয় সদস্য নই, ফলে সবসময় শৃঙ্খলার বেড়াজাল আমার ক্ষেত্রে খাটে না। আমার বহিষ্কৃত হওয়ার কোনও ভয় নেই। তাই নিজের মতো করে নিজের মতামত জানাতে পারি।
গত কয়েক বছরে বামেদের একজনের ভূমিকা আমাকে বারবার নাড়া দিয়ে গেছে। তিনি হলেন আলি ইমরান। উত্তরবঙ্গের লড়াকু নেতা রাজনীতির অঙ্গনে ভিক্টর নামেই বেশি পরিচিত।
এমনিতি তিনি উত্তরবঙ্গের। আমি দক্ষিণবঙ্গের। কাছ থেকে দেখা হওয়ার সুযোগ নেই। এমনকী দূর থেকে বক্তৃতা শোনারও সুযোগ নেই। তবু বিধানসভায় তাঁর সোচ্চার ভূমিকার কথা কাগজে পড়েছি। পুরোটা বেরোয় না। কিন্তু দু–চার লাইন থেকেই বুঝতে পারি, ভেতরের আগুনের উত্তাপ কতটা।
ইদানীং একটা সুবিধা হয়েছে। ইউটিউবে অনেক দূরদূরান্তের মানুষকেও কাছ থেকে জানার একটা সুযোগ এসে যায়। গত কয়েক বছরে তাঁর বেশ কিছু দুরন্ত ভাষণ শোনার সুযোগ হয়েছে। যেমন জমায়েত, তেমনই বাগ্মিতা। মাঝে মাঝেই মনে হয়, এমন একটা দুরন্ত সম্ভাবনাকে বামেরা কাজে লাগাতে পারছে না কেন? অচলায়তন ভেঙে ব্রিগেডে তাঁকে বক্তা করা হয় না কেন? রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় এমন তরতাজা যুবকদের ঘোরানো হয় না কেন?
ইদানীং তাঁর দলের সঙ্গে তাঁর একটা বিরোধ চলছে। যে ছেলেটি তৃণমূলের এত প্রলোভন থাকা সত্ত্বেও যাননি, যে মানুষটা এই কঠিন সময়েও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে এমন লড়াই করছেন, তাঁর লড়াই বোধ হয় তাঁর দলেই সেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে না। তাই দলের মধ্যেই আলাদা মঞ্চ তৈরি করতে হয়েছিল। বাম অনুরাগী হিসেবে বারবার চেয়ে এসেছি, এমন সম্পদকে যেন হাতছাড়া না করা হয়। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যেন এই বিতর্ক মিটিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু আমরা, সাধারণ অনুরাগীরা কীই বা করতে পারি?
আসলে, ভিক্টরের মতো লড়াকু নেতাকে অন্য দলের মঞ্চে দেখতে চাই না। তাই চেয়েছি ভিক্টরও দলীয় মঞ্চে থেকেই লড়াই করুন। কিন্তু পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, জানি না কতদিন এটা সম্ভব হবে। এর মঝে ভিক্টরের একটি কাজও আমাকে কিছুটা আঘাত করেছে। তিনি নাকি দলের সিম্বল কেড়ে নেওয়ার দাবি জানিয়ে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছেন। দলের নেতাদের সঙ্গে তাঁর লড়াই থাকতেই পারে। কিন্তু সিম্বল কেড়ে নেওয়া চিঠি তিনি কেন দিতে যাবেন? হয়ত অন্য কারও কথায় প্রভাবিত হয়ে এমনটা করেছেন। হয়ত তাৎক্ষণিক আবেগের বশে এমনটা করেছেন। কিন্তু আমার মনে হয়, এই নিয়ে আরও একটু ভাবনাচিন্তা করা যেত। এমন হঠকারী আচরণ না করলেও চলত। এতে নিচুতলায় কর্মীদের মধ্যে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হতে পারে। দলের যে নেতারা ভিক্টরকে কোণঠাসা করতে চাইছিলেন, তাঁদের হাতই আরও শক্তিশালী হল। ‘ভিক্টর দলবিরোধী’— এমনটা প্রচার করতে তাঁদের অনেক সুবিধাই হয়ে গেল। এমনকী এর ফলে, তাঁকে বহিষ্কার করার কাজটাও অনেক সহজ হয়ে গেল।
বারবার মনে হয়েছে, ভিক্টর এই ফাঁদে পা না দিলেই পারতেন।
এখনও বিশ্বাস করি, সত্যিই যদি দলবদল করতে চাইতেন, তাহলে অনেক আগেই করতে পারতেন। মন্ত্রী হতে পারতেন। সাংসদ হতে পারতেন। সেইসব হাতছানিকে হেলায় উপেক্ষা করেছেন। কিন্তু সেই ভিক্টরের কাছ থেকে আরও একটু সংযম ও দায়িত্বশীল আচরণ আশা করেছিলাম। অন্তত দলের রাজ্য সম্মেলন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারতেন। কে বলতে পারে, হয়ত তিনিই দলের মুখ হয়ে উঠতে পারতেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমনদিকে মোড় নিল, ইচ্ছে না থাকলেও তাঁকে হয়ত অন্য শিবিরে যেতে হবে। দলের নেতারা কার্যত সেই ব্যবস্থাই নিশ্চিত করলেন।