‌আস্ত একটা মুড়ির মেলা বসে নদীর ধারে

অন্তরা চৌধুরি
বাঁকুড়ার লোকের মুড়ি খাওয়া নিয়ে যে যতই কুৎসা করুক, শুধু মুড়ি খাওয়াকে কেন্দ্র করেই বাঁকুড়াতে একটা আস্ত মুড়ি মেলা হয়। এই মেলার বয়স প্রায় দুশো বছর। মাঘ মাসের ৪ তারিখে এই মেলা হয়। তারিখটা বহুকাল ধরেই নির্ধারিত। নড়চড় হয় না। কেঞ্জাকুড়ার কাছে দ্বারকেশ্বর নদীর চরে সঞ্জীবনী মাতার মন্দিরের সামনে হয় এই মেলা। কিংবদন্তি এই যে, ভান্ডারবেড় গ্রামের জমিদার রায়কিশোর চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সন্ন্যাসী। জমিদার বাড়ির ছেলে হয়েও তিনি সন্ন্যাস নিয়ে তীর্থক্ষেত্রে চলে যান। পরে জমিজমা সংক্রান্ত বিবাদ হওয়ায় তাঁকে কয়েকদিনের জন্য ফিরিয়ে আনা হয়। তখন তিনি শর্ত দিয়েছিলেন যে ফিরে এলেও কারও বাড়িতে থাকবেন না। তাই তাঁর জন্য দ্বারকেশ্বর নদীর তীরে বানিয়ে দেওয়া হয় বাড়ি। সেই বাড়িই এখন মন্দির।
আগে এই মন্দিরে চারদিন ধরে হরিনাম সংকীর্তনের আয়োজন করা হত। দূরদুরান্তের বিভিন্ন গ্রাম থেকে লোকজন আসতেন এই হরিনাম শুনতে। কিন্তু মন্দিরের চারিদিকে তখন এত ঘন জঙ্গল ছিল যে সন্ধ্যেবেলায় তাঁরা আর নিজেদের বাড়ি ফিরে যেতে পারতেন না। তখন তাঁদের একমাত্র ভরসা ছিল নিজেদের সঙ্গে গামছায় বেঁধে আনা মুড়ি। দ্বারকেশ্বর নদী থেকে জল নিয়ে ওই গামছায় মুড়ি মেখে খেয়ে তাঁরা রাতটুকু কাটিয়ে পরের দিন নিজেদের বাড়িতে ফিরে যেতেন। সেই থেকে শুরু এই মুড়িমেলার।
মুড়িমেলায় আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রচুর লোকজন আসেন। শুধু গ্রাম নয় শহর থেকেও লোকজন এসে অংশ নেন এই মুড়ি মেলায়। সব মিলিয়ে দ্বারকেশ্বরের পাড়ে তখন উপচে পড়া ভিড়। বাঁকুড়ার লালমাটির পথ বেয়ে সাদা সাদা ফুলকো মুড়ির সুগন্ধে তখন আকাশ বাতাস মুখরিত। মানুষের কলতানকে সরিয়ে কান পাতলেই শোনা যায় মুড়িতে জল ঢালার সোঁ সোঁ শব্দ। মুড়ি মেলাকে কেন্দ্র করে মানুষের উন্মাদনা চোখে পড়ার মতো। এই একটা মেলার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে কত আবেগ, কত স্বপ্ন, কত ভালোলাগা, কত ভালোবাসা। কারণ এই মেলাতেই মুড়ি খেতে খেতে কত তরুণ তরুণী প্রেমে পড়ে গেছে। পাশের বন্ধুকে ফিসফিসিয়ে হয়তো বলেছে—
‘দ্যাখ, দ্যাখ। মেয়েটা কী দারুণভাবে মুড়িটা চপ দিয়ে মেখে খাচ্ছে।’
ভাবতে পারেন শুধু চপ দিয়ে মুড়ি মেখে খাওয়া দেখে কেউ কারও প্রেমে পড়ে গেছে!
শুধু স্থানীয় মানুষ নয়, পাশাপাশি গ্রামের যাদের দূরে কোথাও বিয়ে হয়েছে তারাও ছানাপোনা নিয়ে এসে পড়ে এই মেলায়। কর্মসূত্রে যারা বাইরে থাকে তারাও কেউ কেউ এসে ঠিক হাজির হয়ে যায়। সত্যিই মুড়ির কী মাহাত্ম্য!
মাঘ মাসের ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে নদীর ধারে সবাই মিলে মুড়ির পিকনিক। আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব মিলে এক জায়গায় জড়ো হয়ে মুড়ি খাওয়ার সে যে কী আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল। তবে মুড়ি মেলায় যাওয়ার কয়েকদিন আগে থাকতেই জোরকদমে প্রস্তুতিটা শুরু হয়ে যায়। কারও ভাগে দায়িত্ব পড়ে মুড়ি নিয়ে যাবার। কেউ পায় চপের দায়িত্ব। কেউ পায় পেঁয়াজ, শসা, কাঁচালঙ্কা, টমেটো, মটরশুটির দায়িত্ব।
তারপর ভোর হতে না হতেই দলে দলে লোকজন সেজেগুজে ভিড় জমাতে শুরু করে নদীর পাড়ে। সঙ্গে করে চপ বা মুড়ি কিছু না থাকলেও কুছ পরোয়া নেহি। কারণ নদীর পাড়েই অনেক অস্থায়ী দোকান বসে। সেখানে মুড়ি খাবার যাবতীয় সরঞ্জাম- চপ, তেলেভাজা, বেগুনি, ভাবরা থেকে শুরু করে চা–‌টা সবই পাওয়া যায়। তবে এই মুড়ি মেলার বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য হল, এদিন এখানে কেউ একা একা মুড়ি খায় না। পরিবার অথবা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে একসাথে বসে মুড়ি খাওয়ার পর্ব চলে। তবে অতখানি মুড়ি এক জায়াগায় মাখার মতো অতবড় পাত্র সকলের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব হয় না বলেই; অনেকে গামছার ওপর মুড়ি খান। গামছাটাকে লম্বা করে পেতে তাতে বেশ অনেকখানা মুড়ি ঢেলে তাতে সরষের তেল, পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা, চপ, বেগুনি, মটরশুটি, ধনেপাতা, শসা, মূলো এসব দেওয়া হয়। নদীতে চুঁয়া খুঁড়ে জল নিয়ে সেই মুড়িকে বেশ জবজবে করে যুতসই মাখা হয়। তারপর চলে সবাই মিলে আনন্দ করে মুড়ি খাওয়ার পর্ব। যে যত খুশি মুড়ি খাও। এই চুঁয়ো খুঁড়ে জল খাওয়া এই মুড়ি মেলার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। এই জল একই সঙ্গে সুস্বাদু ও সুমিষ্ট।
মুড়ি মেলাকে কেন্দ্র করে আরও অন্যান্য জিনিসেরও পসরা বসে। যে যার মতো কেনাকাটা করে। কারও স্নান করতে ইচ্ছে হলে গামছা পরে নদীতে নেমে পড়লেই হল। দুপুরের খাবারের ভাবনা নেই। কারণ সঞ্জীবনী মা-এর মন্দিরে চারদিন ধরে চলে খিচুড়ি খাওয়ানো। সেখানে বসে পড়লেই হল। অনেকে দুপুরেও মুড়ি খেতেই পছন্দ করেন। তারপর দিনের শেষে একরাশ আনন্দ নিয়ে যে যার ঘরে ফিরে যায়। আবার একটা বছরের প্রতীক্ষা। প্রতীক্ষা মুড়িমেলার জন্য। বাড়িতে চার দেওয়ালের ভেতর বুদ্ধিজীবী তকমা সেঁটে স্টাইল করে দুটো মুড়ি খাওয়া, আর মুড়ি মেলায় বাঁধনহীন হয়ে মুড়ি খাওয়ার যে কী আনন্দ তা বাঁকুড়ার মুড়ি মেলায় না গেলে বোঝা অসম্ভব।
তবে শুধু বাঁকুড়ার কেঞ্জাকুড়ায় নয়; বর্ধমানের পানাগড়ের কাঁকসা গ্রামেও পৌষ সংক্রান্তির দিনও এই মুড়ি মেলা হয়। কাজেই মুড়ি খেলে স্ট্যাটাস বাড়ে বৈ কমে না। তাই বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বর্ধমান, বীরভূমের লোকেরা জল দিয়ে মেখে মুড়ি খায় বলে নাখ সিঁটকোবেন না। বরং তাদের মতো করে মুড়ি খেয়ে আপনিও মুড়ি প্রেমী হয়ে উঠুন।
শীতে অনেকেই তো ঘুরতে যান। করোনার ভয়ও অনেকটা কেটে গেছে। বারো মাসে বাহান্ন পার্বণের আবহে মেলাও কম দেখেননি। এবার শীতে না হয় মুড়ি মেলাতেই ঘুরে যান।

‌‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.